Translate

বুধবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

ভেন্টিলেশান

সরাসরি "পরবাস" পত্রিকায় পড়তে হলে, এই লিংকে ক্লিক করুনঃ- 







[বিছানায় টানটান শুয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছিল পৈলান, পৈলান মণ্ডলঘাড়ের নিচে ভাঁজ করা হাত। বেশ হাল্কাপুল্কা মেজাজ। এখন সবে ভোর। আরেকটু বেলা হলেই লোকজন আসা শুরু হবে। সঠিক কতদিন তা মনে নেই, তবে অনেকদিন কেটে গেল বিছানায় শুয়ে। আজকে একটু বেরোবে ভাবছে। নিঃশব্দে দরজা ঠেলে যে ঢুকল, সে বেঁটেখাটো, লাল্টুস দেখতে একজন। তার নাম হুহু!]

হুহুঃ          সুপ্রভাত! আপনার ঘুম ভেঙে গেছে, দেখছি! তাহলে একটু চা দিয়ে যাই, প্রভু’?
পৈলানঃ       সুপ্পোভাত? এখানে গুডমন্নিং বলার রেওয়াজ নেই নাকি হে? তার ওপর আবার পোভু? এমন তো শুনি নাই কভু? হা হা হা হা। বলি যাত্রা-পালা হচ্ছে নাকি বলো তো, পৌরাণিক পালার রিহার্শল করছো? আমি বাপু, ওসব একদম পছন্দ করি না। আমি খাঁটি বাঙালি, বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। আমি গুডমন্নিং, স্যার, এই সব শুনতেই অভ্যস্ত। ওই সব আলফাল বকে আমার মেজাজ খিচড়ে দিও না, বুঝলে?
হুহুঃ          আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রভু...ইয়ে মানে, স্যার। আর ভুল হবে না। আজ্ঞে, এখানে নতুন নতুন তো, সড়গড় হতে একটু সময় লাগবে বৈকি। তবে স্যার, ওই যে বলছিলাম, চা দেবো, না কফি দেবো, স্যার?
পৈলানঃ       চা-ই দাও। সকাল সকাল কফিটা তেমন জমে না। আমার চাটা কেমন হয় জানো তো? চিনি ছাড়া, হাল্কা লিকার, মিষ্টির বড়ি - দুটো
হুহুঃ          লিকার চায়ে মিষ্টির বড়ি? তাহলে একটা কথা জিগ্যেস করি, স্যার? আপনি লিকার চা কী ভালোবেসে খান? নাকি নাচার হয়ে খান?
পৈলানঃ       চিনি ছাড়া লিকার চা শখ করে, কে খায় চাঁদ? সাড়ে চারশোর ওপর সুগার, তার ওপর বুকজ্বলা অম্বল। বাধ্য হয়ে খাই। তিন চামচ চিনি, ঘন দুধের সর জমে ওঠা চা। তবে না চা খেয়ে আরাম, চা খেয়ে মজা!
হুহুঃ          সে আর বলতে, স্যার? কিন্তু এখানে স্যার নো সুগার, নো অম্বল। এক কাপ নিয়ে আসছি খেয়ে দেখুন, স্যার। এখানকার সুগারে সুগার হয় না। এখানকার চায়ে চাইলেও চোঁয়া ঢেঁকুর কিংবা অম্বল হয় না।
পৈলানঃ       গ্রান্টি দিচ্ছ? তবে হলেই বা, আমার আর কী হবে? তোমারই ভোগান্তি হবে। ডাক্তারবাবুকে বলে তোমার চাকরিটা খাবো। তেমন তেমন হলে জেলেও ভরে দেব। বিনা বিচারে সতের বছর। আমাকে বিভভান্ত করার চেষ্টা এবং আমাকে হোত্তা করা চক্কান্ত..., এমন কেস খাওয়াবো না, টের পেয়ে যাবে বাছাধন!
হুহুঃ          [হেসে] না স্যার। গ্যারান্টি। একবার তো ট্রাই করে দেখুন। [দরজার দিকে ফিরতে যায়]
পৈলানঃ       ওহে, শোনো হে, শোনো। হন হন করে তো চললে, বলি নামটা কী তোমার? কী বলে ডাকব?
হুহুঃ          হে হে, স্যার। আমার নাম? আমার নাম শুনে হাসবেন, স্যার।
পৈলানঃ              হে হে ? সে না হয় হাসলামই, কিন্তু নামটা কী শুনিই না।
হুহুঃ          হুহু, স্যার। হুহু গন্ধর্ব
পৈলানঃ       [ভুরু কুঁচকে] হুহু? বেশ বেআক্কেলে নামটা তো, হে! বাঙালি যে নও, সে তো বুঝতেই পারছি। ইউপি না বিহার, নাকি তেলেগু? তা এখানে জুটলে কোত্থেকে?
হুহুঃ          আমরা বহিরাগত নই, স্যার! এইখানেই আমাদের বরাবরের বাসবহুদিনের।
পৈলানঃ       তবে যে একটু আগে বললে, এখানে নতুন নতুন, সড়গড় হতে সময় লাগবে! তোমার রকম সকম আমার একটুও ভাল ঠেকছে না, হে। তোমার ওপর আমার নজর থাকবে, এই বলে দিলাম। এখন যাও, চাটা নিয়ে এসো, তারপর তোমার হচ্ছে...তোমার ওই গন্ধটাও ধরবো।
হুহুঃ          হে হে, গন্ধ নয় স্যার, গন্ধর্ব। [হুহু হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে]

[পৈলান বিছানা থেকে নেমে মেঝেয় দাঁড়ালনিজেকে খুব হাল্কা মনে হচ্ছে তার, যেন কোন ভার নেই! ফাঁকা ঘরে কিছুটা নেচেও নিল আপন মনেতার এই হুমদো চেহারাটার জন্যে গত বছর তিরিশেক নানান অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু এখন আর সে সব নেই। নিজেকে বিশ-বাইশ বছরের ছোকরা মনে হচ্ছে। ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে দেওয়ালে টোকা মেরে...]
পৈলানঃ       এ ঘরের দেওয়ালগুলো কাচের, নাকি পেলাস্টিকের, কে জানে! একটাও জানালা নেই। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাইরে কি কুয়াশা হয়েচে, নাকি মেঘ করেচে? সুজ্যি ওঠার নাম নেই। সেই থেকে মনে হচ্ছে যেন ভোর। মেঘে মেঘে বেলা কত হল কে জানে? এ ঘরে, ব্যাটারা একটা ঘড়িও দেয়নি। ওই গন্ধধরবো নাকি, ব্যাটাকে বলতে হবে একটা ঘড়ি দিতে। আরেকটা...আরেকটা কি যেন, হ্যাঁ মনে পড়েছে, ফোন, ইন্টারকম। না, না ইন্টারকম নয় কলিংবেল হলেই ভালো। বেলটা হাতের কাছে রেখে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। বারবার উঠে ফোন ডায়াল করতে হবেনা। তবে ব্যাটাদের ঘরদোর, বিছানাপত্র বেশ ভালোই। বেশ একটা ঠাণ্ডাঠাণ্ডা ভাব আছে। দেওয়ালে ইস্প্লিট কিংবা কোন এসি দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু...অ, বুঝেছি, এখানে সেন্টাল এসি। শালা সবকিছুই সেন্টালের হাতে!  
              [হুহু হাতে ট্রের ওপর চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল]
              অ্যাই। শোনো হে, তোমাকে কটা কথা বলবো বলেই ভাবছিলাম। ঘরে একটা ঘড়ি রাখোনি কেন বলতো? এটাও কী আমাকে বলে দিতে হবে? তোমার ম্যানেজার কে আছে? ডেকে দিও তো। আর ওই সঙ্গে একটা কলিং বেলও যেন ব্যবস্থা করে। আশ্চর্য। এতটুকু সাধারণ কমন সেন্স যদি থাকে!  আর এই ঘরটাতে জানালা নেই কেন, হে? বাইরের আলো হাওয়া একটু পাওয়া যেত। 
হুহুঃ          আজ্ঞে স্যার এই যে আপনার চা, একটু চুমুক দিয়ে দেখুন তো। মনোমত হল কিনা?
[চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুড়ুৎ শব্দে লম্বা চুমুক দিয়ে]
পৈলানঃ       আঃ। বেড়ে হয়েছে চাটা। মাইরি। মনে হচ্ছে সেই ইয়ং বয়সে যেমন খেতাম আর কি। যেমন মিঠে, তেমনি কড়া লিকারে ঘন দুধ। না তোমাকে যতটা অকম্মা মনে হচ্ছিল, ততটা নও। কিন্তু সেই সুগার আর অম্বলের ব্যাপারটা কিন্তু আমি ভুলছি না, মনে রেখো।
হুহুঃ          ওসব, একদম ভুলে যাবেন স্যার। কোনদিন যে ছিল এমন মনেও হবে না।
পৈলানঃ       বাইরে কি, কুয়াশা করে আছে? নাকি মেঘলা? সেই থেকে সুজ্যি দেখা যাচ্ছে না কেন?
হুহুঃ          আজ্ঞে স্যার, এখানে সবসময় এরকমই – ভোরের আলোর মতো। রোদ্দুরের ধাঁধানো আলোও হয় না, আবার অমবস্যার মিশমিশে অন্ধকারও হয় না।
পৈলানঃ       অ, সব চাইনিজ এলইডি মাল- বুজে গেছি, আমাকে আর বোকা বুঝিও না হে, তোমার চালবাজির কথায় আমি ভুলছি না। ম্যানেজারকে বলে এক্ষুনি একটা ঘড়ি, ওই সঙ্গে ক্যালেন্ডার আমার চাই। আজকে কত তারিখ আর এখন কটা বাজছে, বলো দেখি।
হুহুঃ          আজ্ঞে, এখানে ঘড়ি পাওয়া যায় না, স্যার। ক্যালেণ্ডারও না। এখানে কেউ সময়ও মাপে না, কারো মেয়াদও ফুরোয় না, স্যার। এখানে আসতেই যা কষ্ট, তারপরেই ব্যস - হয়ে গেল। সময় থমকে যায়!
পৈলানঃ       [ভুরু কুঁচকে ধমকের সুরে] কোথায় এসেছি আমি? কিসের কী হয়ে গেল? কী সব আবোলতাবোল বকছো বলো তো?
হুহুঃ          মানে স্যার, ব্যাপারটা চট করে বুঝে ওঠা ভারি শক্ত। নতুন নতুন তো, কদিন থাকুন, ধীরে ধীরে সবই বুঝে যাবেন। এখানে এলে সবাই অনাদি আর অনন্ত হয়ে যায়
পৈলানঃ       [খুব রেগে। আঙুল তুলে] অ্যাই শালা, অনাদি, অনন্তর নাম তুলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? ওদের সব খবর আমি জানতাম বলেই, ওদের দুটোরই আমি খবর লিয়ে লিয়েচিলাম, হ্যাঁ[একটু থেমে] অ, তাই বল, এইবার বুঝেচি, তোরা সব শালা কোন দলের লোক। কিন্তু ভালো কথা বলচি শোন, আমাকে একদম ঘাঁটাস না। সেই থেকে আমাকে তাপ্পি মারচিস? শালা, তোরা আমায় কিডন্যাপ করে এনেচিস, না? [চাটা শেষ করে, হুহুর হাতে খালি কাপটা ধরিয়ে দিল]
হুহুঃ          ব্রেকফাস্টে কী খাবেন, স্যার? মাংসের হালকা ঝোল আর মাংসেরপুর দেওয়া পাঁউরুটি টোস্ট, দিই?
পৈলানঃ       সোজা কথার উত্তর দিবি না, না? তুই খুব হারামি, জানিস তো? সাত হারামির এক হারামি বললেও কম বলা হয়। তোর নামটা বললি গানধরবো! তখন বুঝিনি, আমিও শ্লা টিউবলাইট মেরে গেচি, এখন বুঝছি তুই পাক্কা টেররিস্ট। শুরুর থেকেই তুই আমাকে, গান ধরবো, গান ধরবো করে থ্রেট করচিস, বন্দুক ধরবি? ভেবেছিস আমি গেঁড়ে ভোঁৎনা? ভয় দেখালেই সিঁটিয়ে কাদা? এখন আবার মাংসের ইস্টু, সেন্ডউইচ টুচ খাইয়ে আমার মন ভুলোতে চাচ্চিস? আমার পছন্দ-অপছন্দ সবই তোদের খবরে আছে, কেমন?
হুহুঃ          আপনি খুব বিচলিত হয়ে উঠছেন, স্যার। সবার সব খবরই, আমাদের রাখতে হয়, সেটাই আমাদের কাজ স্যার। যে যেমন কাজ করে, সে তেমনই ফল পায়, এ নিয়ম স্যার, আমাদেরও, আপনাদেরও। বিচলিত হবেন না স্যার। খাবারের সঙ্গে এবার কফি এনে দিই স্যার? আরাম করে খান।
পৈলানঃ       [ভুরু কুঁচকে] অ্যাই, বিচলিত আবার কী রে? তোকে আগেই বললাম না, বাংলায় বল।
হুহুঃ          হে হে। বিচলিত-র বাংলা টেনসান, স্যার।
পৈলানঃ       টেনসান? অ তাই বল। অ্যাঁ কী বললি, টেনসান? শালা তুই আমাকে টেনসান শেখাচ্চিস? আমার মোবাইলটা কোতায়? আমার মোওওবাইলটা কোতায়? ওটা আমাকে একবার দে, তারপর তোদের কেমন টেনসনে দৌড় করাই দেখ। আমার ছেলেরা একবার খবর পেলে না? তোদের হাঁড়ির হাল করে ছাড়বে জেনে রেখে দে।
হুহুঃ          আপনার খাবারটা আমি নিয়ে আসি, স্যার। আরাম করে খানখেতে খেতে না হয় আপনার কথার উত্তর দেওয়া যাবে। [হুহু বেরিয়ে গেল]
পৈলানঃ       [চিন্তিত মুখে, পায়চারি করতে করতে] ছিলাম তো শালা কলকাতার সেরা নার্সিং হোমে। কতদিন ছিলাম, সে তো মনেও নেই ছাতা। কখন ঘুমোতাম, কখন জাগতাম কে জানে। মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখতাম মাথার ওপর সিলিংয়ের ফুটোয় লুকোনো মিটমিটে আলো। বিছানায় শুয়ে আচি বুঝতে পারতাম। আড়ষ্ট ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার ক্ষমতাও ছিল না। তবে সারা গায়ে, নাকে, মুখে গুচ্ছের নল লাগানো ছিল দেখতাম। ডানপাশের দেওয়ালে একটা টিভির মতো নীল পর্দার বাস্কো! বাস্কো নয়, বাস্কো নয়, কি যেন বলে, হ্যাঁ মনে পড়েচে মনিটর মনিটর। স্কুলে ন বছর পড়েছিলাম, সব কেলাসে আমিই মনিটর হতাম। মনিটর মানেই মাতব্বরি। মাতব্বরি ব্যাপারটা আমার জন্ম থেকেই। সেই ভাঙিয়েই তো এত ক্ষমতা আর দাপট। আমার নাম শুনলে, পোয়াতি মেয়েদের গবভোপাত হয়ে যায়। মায়ের কোলে ঘুমকাতুরে খোকারা ডুকরে কেঁদে ওঠে। বিরোধী দলের নেতাদের ধুতি হলুদ হয়ে কেচ্ছা কেলেংকারি হয়। কিন্তু এ ব্যাটারা কারা? কোন দলের? আমাকে তুলে এনেছে বুঝতে পারচিকিন্তু কী চায় কি আমার থেকে! দু-চার পেটি হলে, তেমন পবলেম নেই। সে আমার ঘরেই গোয়ালের মাচায় রাখা আচে। কিন্তু না হলে? এ জায়গাটা কোথায়? এখান থেকে বেরোনোর উপায় কী? তবে হ্যাঁ, একবার বেরোতে পারলে, শালাদের গুষ্টির ষষ্টিপুজো যদি না করে ছাড়ি তো আমার নাম পৈলেন নয়। ওই গান ধরবোটা এবার এলেই, একটু ধাতানি দিয়ে কথা বলতে হবে। আমার ধাতানি হজম করার লোক এ তল্লাটে তেমন আর কই?
[ট্রে হাতে হুহু ঢুকল। প্লেটে স্যাণ্ডউইচ টোস্ট, বোওলে মাংসের স্টু আর কাপে গরম কফি]
হুহুঃ          একদম গরম গরম খেয়ে নিন, স্যার।
পৈলানঃ       হুঁ। তেমন খিদে মনে হচ্চিল না, কিন্তু গন্ধটা হেবি ছেড়েচে, তাতেই কেমন যেন খিদেটা চনমনে হয়ে উঠেচেতোদের পেটের মধ্যে কী মতলবটা আচে বুঝতে পারচি না, তবে ভয় পেয়ে আমি পেটে না খেয়ে দুব্বল হবো, এমন আহাম্মক আমায় ভাবিসনি, রে!
              [স্যাণ্ডউইচে কামড় দিয়ে, এক চামচ সুপ নিল]
              বাঃ। রান্নাবান্না তো ভালই তোদের ক্যান্টিনে। তা তোদের মতলবটা কী খুলে বলবি? আমাকে এখানে এনে বন্দী রেখে তোদের লাভটা কী হবে? এই এত দামি ঘর, এই রকম খাওয়া দাওয়া...তোদের বস কে আচে? তাকে বল না, এসব ভাঁটের খরচা আর সময় নষ্ট না করে, সামনে এসে ঝেড়ে কাশতে!
হুহুঃ          না, না, আপনাকে বন্দী রাখা হয়েচে, এ আপনার ভ্রান্ত ধারণা স্যার! আপনি তো বন্দী নন। আপনি মুক্ত হয়েই তো এখানে এসেছেন! বরং এতদিন যেখানে ছিলেন, সেখানেই আপনি বন্দী ছিলেন!
পৈলানঃ       এখানে বন্দী নই? এই ঘরের বাইরে, যেখানে খুশি আমি যেতে পারি? কী ফালতো বকচিস মাইরি।
হুহুঃ          হ্যাঁ স্যার। যেখানে খুশি আপনি যেতে পারেন। কোন বাধা নেই। তবে এই লোকে পনের দিনের মেয়াদ, তার পরে অন্য লোক।
পৈলানঃ       অ তোর ওই সময় ডিউটি চেঞ্জ হয়ে যাবে বুঝি? অন্য লোক আসবে? তবে পনের দিন তো অনেক দিন রে? তার আগেই আমি চলে যাবো। আচ্ছা, আমি যদি বন্দী না হই, তাহলে আমার মোবাইলটা দিচ্চিস না কেন?
হুহুঃ          এখানে ওটার কাজ কী, স্যার? টালির টুকরো। এখানে নেট ওয়ার্ক নেই, মোবাইল থাকা না থাকা সমান।
পৈলানঃ       এ জায়গাটা কলকাতা থেকে অনেক দূরে?
হুহুঃ          তা স্যার, বেশ খানিকটা দূরেই।
পৈলানঃ       [মুখ ভেংচে] বেশ খানিকটা দূরে, আবে কতটা দূরে বল না?  হতভাগা, আমাকে বন্দী করেই যদি না রাখবি, তাহলে কলকাতা ছেড়ে এখানে নিয়ে এলি কী করতে?
হুহুঃ          আজ্ঞে মুক্তি পেলে এখানেই আসতে হয় প্রথমে, তারপর অন্য লোকে। হে হে, আপনি এতদিন যে ফাঁদে বন্দী ছিলেন, তারপরে আপনাকে কে আবার বন্দী করবে?
পৈলানঃ       আমি বন্দী ছিলাম? হারামজাদা, এমন দেব না কানের গোড়ায়। আমাকে বন্দী করতে পারে এমন কারো ক্ষমতা ছিল বাংলায়?
হুহুঃ          হে হে ছিলেন বৈকি, স্যার। সে এমনই বন্দী, বুঝতেও পারেননি। এই এখন যেমন বুঝতে পারছেন না, যে আপনি মুক্ত। আর আপনি স্যার এখন বাংলাতেও আর নেই।
পৈলানঃ       (চমকে) বাংলাতেও নেই মানে? আমি তাহলে এখন কোথায়? বিহার, ইউপি না দিল্লিতে? কী ভজকট বকচিস মাইরি!
হুহুঃ          ওসব নয়, ওসব নয়, হে হে এ একেবারে অন্যলোকের জায়গা। তবে এ লোকে সবাইকেই একবার আসত হয়। 
পৈলানঃ       হতভাগা জেনে রাখ, অন্যলোকের এলাকাতে আমি একলা যাই না। আমার সঙ্গে সাঙ্গপাঙ্গ থাকে, তাদের হাতে দানা থাকে, নারকেল থাকে। বলা নেই কওয়া নেই, অন্য লোকের এলাকায় এনেচিস কেন বে, আঁটকুড়ির ব্যাটা?
হুহুঃ          আপনি স্যার, সেই থেকে অনেক আকথা কুকথা বলছেন, সেটা না বললেই ভালো, স্যার। আমি আপনার নাড়ি নক্ষত্র, হাঁড়ির খবর সব জানি, কিন্তু আপনি আমার কিছুই জানেন না। কার মধ্যে কী লুকিয়ে আছে কে জানে, স্যার? আর কী কথায় কখন কী ঘটে যায়, কে বলতে পারে? এখানে আবার সব কথার এবং কাজের হিসেবও রাখা হয়, সেটাই মুশকিল।
পৈলানঃ       (সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে স্যুপ খেতে খেতে) (জনান্তিকে) ব্যাটাকে অ্যাত হড়কাচ্চি, তাও হেব্বি ক্যাজুয়াল রয়েছে কিন্তু। উলটে মাঝে মাঝে, আমাকেই দেখচি কচি করে হড়কে দিচ্চে হারামীটার পেছনে বেশ লম্বা হাত আচে বোঝা যাচ্চেহয়তো সিবিআই, ইডি। বুঝেচি, এ শালা নিগ্‌ঘাৎ কেন্দের চক্কান্ত। যাই হোক মাথা গরম করে লাভ হবে না মনে হচ্চেব্যাটাকে অন্য ভাবে ম্যানেজ করা যায় কিন দেখি।
              (স্যুপ স্যাণ্ডউইচ শেষ, এবার কফির কাপে চুমুক দিয়ে) (প্রকাশ্যে) তা বাপু, তোমার ওপর যতোই রাগটাগ করি না কেন, একটা কথা মানতেই হবে, রান্নার হাতটা খাসা। কিসের মাংস ঠিক বুঝলাম না, তবে খুব তার হয়েচে রান্নায়! কোথাকার ঠাকুর হে? আর মাংসটাই বা কিসের?
হুহুঃ          ঠাকুর বলে এখানে কেউ নেই, রান্নাটান্নাও করতে হয় না, স্যার। যে যেমন কর্ম করে, তার মনোমত ঠিকঠাক জিনিষ এখানে তৈরি হয়েই থাকে।
পৈলানঃ       এতো বেশ বেড়ে জায়গা মাইরি। এর পর যেন বলে বসো না, যে এর জন্যে কোন খরচাও হয় না!
হুহুঃ          হে হে, স্যার ঠিকই ধরেছেন, সত্যিই কোন খরচা নেই। সারা জীবনের লুঠপাট, চুরিচামারি করে জমানো পয়সায় ছ্যাদলা ধরে। তারপর সাত ভুতে কামড়াকামড়ি করে সে পয়সার ষষ্ঠীপুজো করে।
পৈলানঃ       তা ঠিক, তবু মন তো মানে না। পোথম পোথম তোমার ওপর একটু বিরক্ত হয়েচিলাম ঠিকই, এখন দেখচি তোমার মধ্যে অনেক গুণ আচে হে। আর পৈলেন মণ্ডল গুণের কদর জানে। ঐ যে অনন্ত, ব্যাটার অনেক গুণ ছিল, খালপাড়ের বস্তি থেকে একদিন ভোরবেলা ফেরার সময় ওকে দেখেছিলাম। আর দেখেই বুঝেছিলাম ওর ভেতরে মাল আচেতুলে এনে সঙ্গে রাখলাম কদিন। ঝট করে তৈরি হয়ে গেল, জান?
হুহুঃ          হে হে, সে আপনার হাত যশ।
পৈলানঃ       সেই অনন্ত, আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে, দু বছরে রাজার ব্যাটা কেরাসিনওয়ালা বানিয়ে দিলাম! আর সেই কিনা এলো আমার পেছনে কাটি করতে? এমন বিশ্বেসঘাতক! দিলেম শালাকে টপকে।
হুহুঃ          জানি, স্যার।
পৈলানঃ       আর ওই অনাদি? আমার বিরোধী দলে ছিল, ওখানে ব্যাটাকে ল্যাজেগোবরে অবস্থা করে ছেড়েছিল। যে কোনদিন লাশ হয়ে ভুরভুরি কাটত পোড়ো সেপটিক ট্যাংকে। একদিন মাঝ রাত্রে ধড়াস করে পায়ে এসে পড়ল, পলুদা বাঁচাও। আমার চোখের কোলটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠল।
হুহুঃ          হে হে, সে আর বলতে? আপনার দয়ার শরীর।
পৈলানঃ       আরে তা নয়, তা নয়। পেটে জল পড়লে আমার মনটা কেমন যেন মাখো মাখো হয়ে যায়। সেই অনাদি অনন্তর সঙ্গে ভিড়ে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার ছক কষছিল। দিলাম শালার ঘন্টা বাজিয়ে।
হুহুঃ          হে হে, আপনিই তো শেষ বিচারের মালিক। এই তুলছেন, এই খালাস করছেন।
পৈলানঃ       ছেঁদো গ্যাস দিয়ে লাভ নেই, গন্ধকাজের কথাটা শোন। এখানে কত পাও? বলি ফিউচারের কথা কিছু ভেবেছ? সারা জীবন এভাবেই কাটাবে? নাকি দু পয়সা কামিয়ে, একটু রোখঠোক রোয়াবি দেখিয়ে রাজার হালে থাকবে?
হুহুঃ          আজ্ঞে, সে আর বলতে? আর উণিশ বিশ হলেই খালে লাশ - একেবারে খাল্লাস।
পৈলানঃ       আরে তা কেন? সবাই কী আর ওদের মতো নাকি? ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।
হুহুঃ          সে কথা একশবার, আমাদের ভাবনা তো আপনি ভেবেই রেখেছেন। আপনার নিজের দলেরই আটত্রিশজন এখন মাটির তলায় কংকাল হয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। আর ষোলজনের, বানিয়ে তোলা মামলায় যাবজ্জীবন চলছে।
পৈলানঃ       (ভুরু কুঁচকে) বেশ ছোকরা হে, তুমি! আমার থেকেও তোমার দেখি সব হিসেব একেবারে মুখস্থ!
হুহুঃ          আজ্ঞে তা তো হবেই! আপনার হরেক লীলা, সব কী আর আপনার মনে রাখা ঠিক হয়? এরপর আছে বিরোধী দলের একশ আটত্রিশ জন, আর নিরীহ আম জনগণ গোটা চল্লিশেক তো হবেই!
পৈলানঃ       (কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে) সব কী আর মনে আছে? কাজের মধ্যে অমন দু চারটে হয়েই যায়। আর ওসব না করলে লোকে মান্যিগণ্যিই বা করবে কেন? আর পাব্লিকের মনে ভয়ভক্তিই বা আসবে কোত্থেকে, হে? ওটাই তো আমাদের পোফেসন, ওটাই তো আমাদের ইউএসপি। ওটুকু না থাকলে, পলিটিক্যাল ন্যাতারা আমাদের দিয়ে ঘরও মোছাবে না, হে।
হুহুঃ          আর পলিটিক্যাল হাতটা যদি মাথায় না থাকে, ক্ষমতার ল্যাজ নাড়াই বা থাকবে কোথায়?
পৈলানঃ       তুমি বেশ চালাকচতুরও আচো, অ্যাঁ? ভেজা বেড়ালটা সেজে থাকো, দেখে বোঝাই যায় না। এখনই কিছু বলতে হবে না। ভালো করে চিন্তা ভাবনা করে দেখ। এখান থেকে সটকে নিয়ে একবারটি আমায় কলকাতায় নিয়ে চলো, তারপর তোমার লাইফ কেমন বানিয়ে দিই দেখবে! হে হে, এটুকু না বোঝার মতো বোকা তুমি তো নও হে!
হুহুঃ          আজ্ঞে, ভাবনা চিন্তার বাকি আর কী রাখলেন বলুন দেখি?
পৈলানঃ       বলো কী হে, ভাবনা চিন্তা করেই ফেলেছ? বা বেশ বেশ। তা বেরোবার আগে লাঞ্চের ব্যবস্থা কিছু করেচ নাকি? দুপুরে ওই মাংসের কষা আর খান কতক পরোটা বানাবে নাকি? যাওয়ার আগে এ পাড়ার খাবারটা জমিয়ে খেয়েই যায়। আচ্ছা, ওই মাংসটা কিসের বলো তো হে, অমন স্বাদ এর আগে কোনদিন পাই নি।
হুহুঃ          ও তেমন কিছু না, স্যার। যেমন সস্তা, তেমনি সহজেই পাওয়া যায়। মানে এ মাংসের কোনদিন অভাব হয় না, স্যার। হালাল কিংবা ঝটকা; গরু কিংবা শুয়োর –এসব কোন লাফড়াও নেই, স্যার!।
পৈলানঃ       বলো কী হে? সস্তায় এমন মাংস, কিসের বলো তো?
হুহুঃ          আপনি জানেন, স্যার, আপনার খুবই প্রিয় মাংস। ওটা নরমাংস, স্যার।
পৈলানঃ       অ তাই বলো! অ্যাঁঃ কী বললি? নরমাংস? আরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ তোর পেটে পেটে এই ছিল, গন্ধ?
হুহুঃ          কেন স্যার? কিছু অন্যায় করে ফেললাম নাকি, স্যার? একটা মানুষখেকো বাঘ, কিংবা একটা হাঙর সারা জীবনেও অতো মানুষ খেতে পারে না স্যার, এই ক বছরে আপনি যা খেয়েছেন।
পৈলানঃ       হ্যাক থুঃ থুঃ। ছিঃ ছিঃ। কোন শালা বলে আমি নরমাংস খেয়েছি? লাশ ফেললেই তার মাংস খাওয়া হয়ে যায়? আমার মতো একজন সমাজসেবীকে তুই নরমাংস খাওয়ালি?
হুহুঃ          এ হে হে, আপনি এত ছ্যাছ্যা থুথু করছেন কেন স্যার, মানুষ কি এতই অখাদ্য স্যার? বাঘ ভাল্লুক স্যার কখনো কখনো মানুষ মারে পেটের জ্বালায়, আপনি মারেন, স্যার ক্ষমতা আর টাকার জ্বালায়। তা স্যার একটু খেয়ে দেখতে দোষ কী?
পৈলানঃ       তোকে আমি ফাঁসিতে চড়াবো। তোকে আমি... আমি...ওয়াক ওয়াক...ওরে বাবা আমার কেমন গা গুলোচ্ছে...ইস...ইস...ছ্যাঃ ছ্যাঃ...ওয়াক ওয়াক...

[আলো নিভে গেল, কিছুক্ষণ পৈলানের ‘ওয়াক ওয়াক, থু থু’ আর হুহুর ‘ঘাবড়াবেন না স্যার, সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম অমন হতে পারে স্যার’ শোনা যেতে লাগল...তারপর হুহুর কণ্ঠের বদলে একটি মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘স্যার, স্যার একটু শান্ত হোন স্যার, ও স্যার, স্যার...’আলো জ্বলে উঠলে দেখা গেল, হস্পিট্যালের বেডে পৈলেন শুয়ে শুয়ে ছটফট করছে, তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে একটি নার্স, নাম পিংকি পৈলানের সারা গায়ে নাকে মুখে নানান টিউব, সে সব খুলে সে উঠে পড়তে চাইছে।]

পিংকিঃ       বীণাদি, শিখাদি একবার আসবে গো, পেশেন্ট হঠাৎ কেমন করছে দেখে যাও। সামলাতে পারছি না। ও বীণাদি, ও শিখাদি।
              [আরো দুই নার্স বীণা আর শিখা দৌড়ে ঢুকল কেবিনে]
বীণাঃ         ও মা, এ আবার কী হল রে? কোমার পেশেন্ট এমন কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করে এই প্রথম দেখছি শিখা তুই স্যারকে বরং একবার ফোন কর। আমি আর পিংকি ততক্ষণ দেখছি একে শান্ত করা যায় কি না
              [শিখা মোবাইলে ডায়াল করতে থাকে]
শিখাঃ        যাচ্চলে, নেট ওয়ার্ক সীমার বাইরে বলছে।
বীণাঃ         যাচ্ছেতাই নেট ওয়ার্ক। আবার কর
শিখাঃ        দাঁড়া দাঁড়া রিং হচ্ছে...রিং হচ্ছে...রিং হচ্ছে...যাঃ, স্যার তুললেন না।
বীণাঃ         ছেড়ে দে, এখন আর তাড়া নেই। পেশেন্ট ঠাণ্ডা মেরে গেছে...এখন আর কোমা নয়, একদম ফুলস্টপ।
পিংকিঃ       তাহলে, ভেন্টিলেশান খুলে দিই?
বীণাঃ         পাগল হয়েছিস? ভেণ্টিলেশন চলুক...বড়ো বড়ো ডাক্তাররা আসুক, তাঁরা যা করার করবেনরাত এখনো ঢের বাকি, যা একটু ঘুমিয়ে নে। কাল সকাল থেকে আবার কোমার ডিউটি... এ কোমা কবে কমবে, কে জানে? 

[তিনজন বেডের দুপাশে দাঁড়িয়ে পৈলানের দিকে তাকিয়ে রইল। পর্দা নেমে এল]

..০০..       

মৃত্যুর মিছিল


সরাসরি "পরবাস" পত্রিকায় পড়তে হলে এই লিংকে ক্লিক করুনঃ- 





এ বাড়িতে আসা ইস্তক খুব খিদে পায় খগেনের। না খেতেপাওয়া সারা জীবনের সমস্ত খিদে যেন জমা হয়েছে তার উদরে। পুবের আলো ফুটতে না ফুটতেই তার ঘুম ভেঙে যায় রোজ। আজও ভেঙেছিল। গাঁয়ে ঘরে সকালে উঠেই মুখ ধোয়ার তেমন কোন কারণ ছিল না। ধুতোও না। একে তো তার একটাও দাঁত নেই, তার ওপর কখন কী খাবার জুটবে তারও ঠিকানা ছিল না। মুখ ধুয়ে, চোখের পিচুটি মুছে তার আর কোন রাজ কাজ ছিল, যে রোজ নিয়মিত মুখ ধোবে? এ বাড়িতে ওসব চলবে না। কড়া হুকুম। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে, ফিটফাট বাবুটি হয়ে বসে থাকতে হবে তবে না মিলবে খাবার!
গুঁড়ো মাজন বাঁহাতের তালুতে নিয়ে, লালায় ভেজানো ডানহাতের তর্জনিতে তুলে, সে এখন রোজ মাড়ি মালিশ করে। মিষ্টি স্বাদ আর সুন্দর গন্ধে ভরে ওঠে তার মুখ। অনেকক্ষণ, বেশ অনেকক্ষণ সে মুখের মধ্যে আঙুল পুরে বসে থাকে, পুব আকাশের দিকে চেয়ে। পুবের আকাশ আরো উজ্জ্বল হয়। পাকপাখালিরা বাসা থেকে বেরিয়ে, গাছের খোলা ডালে বসে শরীরের আড় ভাঙে। তাদের যতরকমের ডাক আছে সবগুলি ডেকেডুকে গলাটাও সাফ সুতরো করে নেয়। তারপর উড়ে যায় খাবারের সন্ধানে। তাদের দিকে তাকিয়ে খগেনের মনে করুণা হয়। ছিঃ কী অসভ্য ওরা! সভ্য সমাজে বাস করতে হলে, রোজ সকালে উঠে যে দাঁত মাজতে হয়, মুখ ধুতে হয়, চোখের পিছুটি সাফ করতে হয়, সেই সহবতটুকুও কী ওরা শেখে না, ওদের বাপ-মার থেকে? কিংবা ওদের ছেলেদের থেকে। যেমন খগেন শিখেছে তার উপযুক্ত ছেলের থেকে। শেখার কি কোন বয়েস আছে রে, পাগল? চিতার চড়ার আগেও তাই শিখতে হয়। শেখার ছাই শেষও নেই, ছাই হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত।
এই কাকভোরে বাড়ির লোক কেউ ওঠে না। তবু আড়চোখে ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে, মাজন গোলা লালা দু একবার ঢোঁক গিলে নেয়, খগেন। খেতে খারাপ নয় মোটেই, মুখ থেকে উদর পর্যন্ত মিষ্টি স্বাদ আর সুবাসে শরীরটা বেশ মজে ওঠে। তারপর অনেকটা সময় মুখের মধ্যে আঙুল নাড়াচাড়া করে, খগেন কুয়োতলায় যায়। দড়ি বাঁধা দুধ দোয়ার ছোট বালতিটা পাড় থেকে ঝপাং করে জলে ফেলে, দড়ির অন্য প্রান্তটা টানতে থাকে, লোহার আংটায় ঝোলানো পুলিতে আওয়াজ ওঠে কিঁচ, কিঁচ কিঁচ– ছুঁচোর ডাকের মতো দড়ির টানে, ভরা বালতির কিছুটা জল ছলাৎ ছলাৎ ফিরে যায় কুয়োর গর্তেই। আর এইসময়েই খগেন যে খগেন, সেও কিছুটা দার্শনিক হয়ে ওঠে। জলই জীবের জেবন, সে কথাটা খগেন জানে। আর জেবন যেমন অনেক কিছু দেবার জন্যে এগিয়ে এসেও, সবটা দেয় না। কিছুটা ফিরিয়ে রেখে দেয় নিজের জন্যে। কুয়ো থেকে দুলে দুলে উঠে আসা ওই বালতি ভরা জলের মতো, অনেকটা উঠে আসে ঠিকই কিন্তু বেশ কিছুটা সে ফিরিয়ে নেয় কুয়োর মধ্যে!
আঁজলা ভরে জল নিয়ে সে মুখ ধোয়, চোখ সাফ করে। ঘাড়ে কানের পেছনে জলো হাত ঘষে। তারপর প্রায় গলা অব্দি আঙুল চালিয়ে জিভ সাফ করে, গলা সাফ করে। চিৎকার করে ওঠে অ্যা অ্যা অ্যা অ্যা...হ্যা অ্যাক ...থুঃ। বিড়ির ধোঁয়া মাখা কালচে গয়ের তুলে বার বার ছুঁড়ে দেয় নর্দমায়। বড়ো আনন্দ পায় খগেন, শরীরের ভেতরের জমে থাকা যত কাচড়া-আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে, সে যেন ফিরে পাচ্ছে লতুন জেবন। আর ঠিক এই সময়েই তার কানে বেজে ওঠে সানাইয়ের সুর। আজ বাদে কাল তার ছেলের বিয়ে!। সকাল থেকে পাড়া মাতায় করে, বক্সে সানাই বাজছে। হুঁ হুঁ, খগেনের ব্যাটার বে’।  কাল রাত পোয়ালেই সে তার বেটার বউয়ের শ্বশুর...দেখলে হবে? খরচা আছে!
 নিজের ঘরে গিয়ে হাতপামুখ মাথা মুছে, কাচা লুঙ্গি পরে, গায়ে দেয় সাদা ফটফটে বেনিয়ান।  কে বলবে, আজকের এই খগেন এই সেদিনও খগা ছিল? বারান্দায় রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে, খগেন মন দিয়ে শুনতে লাগল সানাইয়ের সুর। তার উদরেও বাজতে থাকে খিদের মুদারা। একটা লেড়ো দিয়ে এক গেলাস দুধ চা পেটে পরলে, খিদেটা অনেকটা মেটে। নিজের জায়গায় হলে, খগেন টুকটুক করে বেরিয়ে পড়ত ইদ্রিশের চায়ের দোকানে। ইদ্রিশ মিয়া, কড়া লিকারে ঘন দুধ আর ভরপুর চিনিতে যা চা বানায় না, আঃ জিভের আড় ভেঙে মগজ অব্দি চানকে ওঠে। চাটা শেষ করে লালসুতোর একটা বিড়ি ধরালেই, ব্যস - শরীরে টগবগিয়ে জান ফিরে আসে। ইদ্রিশ মিয়া বলে, এক এক কাপ চায়ে এক কাপ রক্ত। তা সে চা রক্তই বটে, গতর টসটসে চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
এ পাড়ায় সে সুযোগ নেই। ছোট্ট মফস্বল শহরের এই পাড়ায় তার ছেলের খুব নামডাক। প্রথম দিনই তার ছেলে তাকে বলে দিয়েছিল, দেখ, যখন তখন আলফাল কোথাও ঢুকে পড়বে না। তোমার যা পেয়োজন আমাদের বলবে, পেয়ে যাবে। মনে রেখো, এখানে তোমার এই ব্যাটার একটা সুখ্যাত আছে, পাড়ার লোক মানিগণ্যি করে। তার বাপ হয়ে, তুমি আদাড়ে পাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে, এ চলবে না। খগেন তার ছেলে মোহিতকে যেমন সমীহ করে, তেমনি ভয়ও পায়। ছেলের মতো ছেলে বটে একখান। গর্বে বুকের খাঁচাটা ফুলে ওঠে, সে খাঁচার পেরাণপাকিটা আনন্দে ঝটপট করে। গাঁয়ে ঘরে, খগেন আর তার ব্যাটা মোহিতকে কেউ পুঁছতো? কেউ ঘরে ডেকে এক কাপ চা খাইয়েছে, কোনদিন? আর এখানে? তার ব্যাটা মোহিত এখন মোহিতদা, আদর করে সবাই ডাকে মদ্দা। এক ডাকে সবাই চেনে। তার ভটভটির আওয়াজ কানে এলে, দুঁদে হাড়বজ্জাত লোকেরাও সমঝে সিধে হয়ে যায়। কুচুটে ধান্দাবাজ লোকেদের মুখেও তখন অমায়িক হাসি, হেহে হেহে, মদ্দা, খপর ভালো তো?

সাতসকালে খগেন সেদিন ঘরেই ছিল। ঘরের সামনে এসে ভটভটির আওয়াজটা থামতে সে বেশ ভয় পেয়েছিল। সক্কালসক্কাল তার কাছে কে আবার এল রে, বাবা? এই সব ভার ভারিক্কি আওয়াজ, গম্ভীর গণ্যিমান্যি কাজের লোকজন, তার কাছে কেউ এলে, খগেনের পেটের ভেতরটা গুরগুর করে ওঠে। বাহ্যে পায়। সে যখন দেখল, ভটভটি থামিয়ে একটা লোক, পিঠে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে, তার ঘরের দিকেই আসছে, সে আর থাকতে পারল নাবাড়ির পিছন দিকে বাঁশঝাড়ের দিকে খগেন প্রায় দৌড়ে চলল আর নাছোড় লোকটাও দৌড়ে এসে, শক্ত হাতে খপ করে ধরল তার হাতটা,
‘বলি চললে কোতায়?’
‘কোতাও যাইনি, আজ্ঞে। পেটে বড্ডো মোচড় মারল, তাই বাজ্জে যেতেছিলাম’।  
‘আমায় চিনতি পারলে নি, বাবা? আমি মোহিত থুমি সেই আজও একই রকম মেনিমুখোই রয়ে গেলে? বাইরের লোক দেকলেই হাগতে ছুটতেচো?’
‘হে হে হে হে, মোহিত? হঠাৎ কোতা থিকে এলি বাপ? চোখে ভালো ঠাওর করতে পারি না কী না? তাই চিনতে পারি না’মোহিত বাপের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তারপর বলল,
‘বেশ বুড়ো হয়ে গেচো, দেখতিচি? একটাও দাঁত নাই, ফোগলা। চোখে কি ছানিও পড়েচে নাকি? এই কবচরে এত বুড়ো হয়ে গেলে কী করে?’ তার গলায় মায়াপরিচয়ে এই লোকটা তার বাপ। ভিতু, দুব্বল, খুবই অসহায় টাইপসর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি, কিছু অন্যায় হয়ে গেল। খগেনের হাতটা ছেড়ে দিয়ে মোহিত ঘরের দাওয়ায় বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে বলল,
‘ঘর দোরের কী হাল করে রেকেচো? এই ঘরে কুকুর বেড়ালও থাকতে পারবেনি, একেনে মানুষ থাকে’? মোহিতের সুন্দর জামা প্যান্ট, জুতো, চুলের কায়দা গলায় চিকচিকে চেন, হাতে ইস্টিলের বালা। এসব দেখে মুগ্ধ হতে থাকল খগেন। তার ওপরে মোহিতের গায়ের সুবাস? আহা। দাওয়ায় বসে বাবুদের ছেলের মতো দেখতে ওই লোকটা তার ব্যাটা, মোহিত? পেত্যয় হয় কই? খগেন ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল,
‘গলার ওটা কী সোনার?’
‘লয় তো কি, পেতলের? হা হা হা হা’। মোহিতের দমফাটা হাসির আওয়াজেও খগেন বড়ো আনন্দ পেল। এমন হাসি সে জীবনে কোনদিন হাসতে পারেনি। খুকখুকে হালকা হাসি হাসতে গিয়েও তার বুকে হাঁফ ধরে, কাশি চলে আসে। আশেপাশের লোকজন কেউ কিছু মনে করল কী না! তার দিকে কেউ তাকিয়ে রয়েছে কী না! দশজনকে শুনিয়ে এমন হা হা হাসি তো সে চিন্তা করতেই পারে না। ছেলের প্রতি শ্রদ্ধায় আর সমীহে সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল বাপের এই দৃষ্টিটা মোহিত তারিয়ে উপভোগ করল কিছুক্ষণ, তারপর হেসে জিগ্যেস করল,
‘কাজ কম্ম কিছু করচো? নাকি ফোপরদালালি করেই দিন কাটাচ্চো?’ লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গেল খগেন,
‘হে হে হে ওই আর কী? চলে যাচ্ছে কোনরকমে’।
‘বুজে গেচি। তোমার ঘরে কী মালপত্র আচে, তল্পিতল্পা বাঁধো। তা’পরে আমার সঙ্গে চলো’।
‘ক্যা্নে? কোতায় যাবো তোর সঙ্গে?’ খগেনের অবাক জিজ্ঞাসায়, মোহিত হেসে উত্তর দিল,  
‘আমার বাড়ি যাবে সামনের শনিবার আমার বে, সোমবার বৌভাত। ছেলের বাপ না গেলে বে’ বাড়ি মানাবে ক্যানে? তবে এ চেহারায় তোমার যাওয়া চলবে নি। মাথায় ফুলেল তেল মেকে, গায়ে সাবান মেকে পুকুরে দুটো ডুব মেরে এসো। ধুতি জামাও সঙ্গে এনেচি। চামড়ার চটিও আচে। বলি মোহিতের বাপ কী যে সে মানুষ বটে? এমন অখদ্দে চেহারা লিয়ে সকলের সামনে দাঁড়ালে হব্যে? ছেলের বউ শ্বশুর বলে মান্যি করবে ক্যানে?’


হরিহর সর্দারের বাড়ির নিচের তলার বৈঠকখানাটা বেশ বড় একটা হলঘর। মেঝেয় পাতলা গদির ওপর সাদা চাদর বিছানো। দেয়ালের ধারে ধারে পাঁচসাতখান চেয়ার আছে ঠিকই, সেগুলোতে তেমন কেউ বসে না। কোমরে ব্যথা, হাঁটু ভাঁজ না হওয়া লোকজন এসে গেলে, গদিতে বসতে পারে না, তারাই ওই চেয়ারে বসে। তবে তারাও খুব স্বস্তিতে বসতে পারে না, পাছাটা কোনমতে চেয়ারে ঠেকিয়ে রাখে। হরিহর সর্দার মেঝের গদিতে বসে আছেন, আর তার সামনে কেউ নিশ্চিন্তে চেয়ারে বসে থাকবে, এমন ভাবা যায়? অনেকে তো ঠায় দাঁড়িয়েই থাক। বার বার বললেও উত্তর দেয়, ‘না, না, স্যার এই বেশ আছি’।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ হরিহর বৈঠকখানায় ঢুকেই ধপাস করে আড় হয়ে বসলেন গদিতে, বললেন, ‘এসিটা বাড়িয়ে দে তো। আলোও এত কম কেন ঘরে?’ ঘরের দুটো এসি বাইশে চলছিল, এখন দুটোই আঠারোয় নেমে এল। ঘরের আলোগুলোও সব জ্বলে উঠল ফটাফট। হরিহর সর্দারের মুখ থেকে কথা খসে পড়া মানে, সে কথা রিমোটের থেকেও কার্যকরী। নিজে নিজেই সব নিয়ন্ত্রণ হতে থাকে।
সেই সাতসকালে হরিহর সর্দার কলকাতা গিয়েছিলেন, ফিরছেন এখন। সারাদিন দফায় দফায় আলোচনা, পর্যালোচনা। নির্দেশ, সতর্কবাণী, উপদেশপরবর্তী কর্ম পন্থা, রাজনৈতিক চাল। প্রত্যেক মাসে একদিন, এই কর্মীসভা শরীরের সব রস রক্ত শুষে নেয়। বড়ো কাঁচের একগ্লাস পরিমিত শীতল জল এগিয়ে এল হরিহরের সামনে। গ্লাসের জল নিঃশেষ করে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন হরিহর,
‘আঃ। কোথায় রে, কোথায় গেলি সব? বলি জলটলের ব্যবস্থা কিছু আছে?’ নিতাই সামন্ত সামনে এসে দাঁড়াল, বলল,
‘ব্যবস্থা আছে স্যার, এখনই নিয়ে আসছে। বাইরে চারটে চাষাভূষো লোক সেই বিকেল থেকে অপেক্ষা করছে, দেখা করতে চায়। ডাকবো?’
‘আঃ কি হয়েছে কী? ওদের আজ যেতে বল, আজ আর হবে না। বল কাল সকালে আসতে। একরাতের মধ্যে কিছু যাবে আসবে না’।
‘ঠিক আছে, স্যার। বলে দিচ্ছি’।
‘হুঁ ভালো করে বুঝিয়ে বলিস। জনগণ নিয়েই আমাদের কারবার, জনতার সেবাই আমাদের ধর্ম, শাআআল্লা, কী উপদেশ! আর ইয়ে, হৃদয় আর পুলক আছে? দুজনকেই ডাক। আর কেউ যেন বিরক্ত না করে’।
নিতাই সামন্ত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই হৃদয় আর পুলক দরজা খুলে মুখ বাড়াল, পুলক বলল, 
‘ডাকছিলেন, দাদা?’
‘হুঁ। ভেতরে আয়। জরুরি কথা আছে’।
ওরা দুজনে ভেতরে ঢুকে, হরিহরের সামনেই গদিতে বসল। ঘরের ভেতরের দরজা দিয়ে হারান পল্লে নিঃশব্দে ঘরে এল। তার হাতের বড় ট্রেতে সাজানো বিদেশী স্কচের বোতল, বরফ, ঠাণ্ডা জলের জগ, চারটে খালি কাঁচের গেলাস। হরিহরের সামনে ট্রে রেখে বোতল থেকে মাপ করে স্কচ ঢালল গেলাসে, তাতে চারটে বরফের টুকরো দিল, ঠাণ্ডা জলও ঢালল গেলাসে। হারানের হাত থেকে গেলাস নিয়ে হালকা চুমুক দিলেন হরিহর। সারা দিনের টেনসানের পর এই স্কচের গন্ধ আর স্বাদ, অনেকটা স্বস্তি পেলেন হরিহর। তাঁর চোখের ইশারায় আরো দুটো গেলাস রেডি করল হারান। এগিয়ে দিল হৃদয় আর পুলকের দিকেকৃতার্থের মতো হৃদয় আর পুলক ডান হাত বাড়িয়ে গেলাস নিল, বাঁহাতে ছুঁয়ে রইল ডানহাতের কনুই। হরিহর নিজের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে গেলাসের ওপর দিয়ে তাকিয়ে ইশারা করলেন, হৃদয় আর পুলক খুব সংকোচের সঙ্গে গেলাসে ছোট্ট চুমুক দিল। তারপর দুহাতে গেলাস ধরে উন্মুখ বসে রইল হরিহরের পরবর্তী আদেশ শোনার জন্যে। হরিহর, আরেকটু আড় হয়ে আধশোয়া হলেন, হারানকে বললেন,
‘তুই এখন যা। একটু স্যালাডের ব্যবস্থা দেখ। আর বাদাম-টাদাম, কিসমিস-টিসমিস...।’ হারান নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। ঘরে এখন তিনজন, নিবিড় নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুক্ষণ হরিহর কোন কথা বললেন না, ধীরে ধীরে গেলাসে দুবার চুমুক দিলেন, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ব্যাপারটা তো কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে রে? তোরা সবাই থাকতে, আমাকে আজ কলকাতা গিয়ে পঞ্চাশটা কথা শুনতে হলো? কী করতে চাস খুলে বল। পলিটিক্স ছেড়ে হরিনামের দল খুলবি? আমাদের দিয়ে তার বেশি কিছু হবে না,  আমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে’।
‘ক্‌-ক্‌-কোন ব্যাপারটা, হরিদা?’ হৃদয় তোতলা হয়ে গেল ভয়ে। হৃদয়ের দিকে বিরক্তি আর করুণাঘন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হরিহর গেলাসে চুমুক দিল। পুলক একটু বেশী ধূর্ত, সে বলে উঠল,
‘আরেঃ মোহিতদাদা মোহিতর কথা বলছেন। তোকে তখন বললাম না, মোহিত এখন খুব উড়ছে। ওর ডানা ভাঙার সময় হয়ে এসেছে’।
‘কিন্তু। ও তো আমাদেরই দলে। আমাদের হয়েই তো লাস্ট ইলেকসনে দাদার জন্যে ময়দান সাফ করেছিল’। এবার পুলকও বিরক্ত হল। বলল,
‘আঃ। তাই বলে কী সে আমাদেরই ঘাড়ে হাগবে? যা খুশী করবে? বিয়েতে কত খরচ করল দেখলি না? সে পয়সা কোথা থেকে পেল? সে টাকাটা ফান্ডে আসতে পারতো কিনা?’
নিজের নির্বুদ্ধিতায় হৃদয় চুপ করে রইল। সে কাজের ছেলে, প্যাঁচ পয়জার ভালো বোঝে না। কিন্তু আদেশ পেলে নিখুঁতভাবে কাজ সম্পন্ন করে। হরিহর কিছু বললেন না, দুজনের দিকে তাকিয়ে ওদের কথা শুনতে লাগলেন, গেলাসে চুমুক দিতে দিতে।
‘দাদা, আমি বলি কী, ওকে ওয়ারনিং দিয়ে বসিয়ে দিন। কমাস খাক না ব্যাটা বসে বসে, জমানো পয়সা ভাঙিয়েকত ধানে কত চাল হয় বুঝে যাবে। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া দুদিনে টাইট হয়ে যাবে’
হারান দুটো প্লেট নিয়ে ঘরে এল। এক প্লেটে শসার টুকরো, অন্য প্লেটে কিসমিস আর রোস্টেড কাজুহরিহর সর্দারের সামনে প্লেট দুটো নামিয়ে, খুব নিচু স্বরে বলল, ‘গেলাসটা আরেকবার ভরে দিই?’ হরিহর সর্দার নিজের গেলাসের তলানিটুকু এক চুমুকে শেষ করে, হারানের দিকে গেলাসটা বাড়িয়ে দিলেন। হারান বসল, আর একবার গেলাস ভরতে। হরিহর সর্দার ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে ভুরু তুলে বলল,
‘মোহিত কাজের ছেলে। বসিয়ে দিলে, অন্য পার্টি ওকে তুলে নেবে। আমাদের হাতের বাইরে চলে গিয়ে, কেস আরো জটিল হয়ে যাবে রে, গাধা!’ পুলক একটু দমে গেল, বলল,
‘তাহলে কী বলছেন? ডানা ছেঁটে দেবো?’ হারানের হাত থেকে ভরা গেলাস নিয়ে হরিহর সর্দার কয়েকটা কাজু নিলেন, দুটো মুখে ফেলে বললেন,
‘মোহিতর সেই কেসটার কথা মনে আছে?’ পুলক আর হৃদয়ের গেলাসও ভরে দিল হারান। পুলক একটা শসা নিয়ে মুখে পুরে বলল,
‘আছে তো, সেটাকে আপনিই তখন চেপে দিয়েছিলেন। তখন থানার ওসি ছিল বিকাশ হাজরা’।
‘কাল সকালেই সুমন মিদ্দাকে বল, সেই ফাইল বের করে, কেস শুরু করতে। তদন্ত হোক, আইন আইনের পথে চলুক’।
‘একটা কথা বলব, দাদা? মোহিত তার বাপকে এনে এখানে রেখেছে। খগেন। সে কিন্তু মোক্ষম সাক্ষী হতে পারে’। দেড় গেলাসের নেশায় হরিহর সর্দারের মেজাজটা হালকা হচ্ছে। এক চোখ বন্ধ করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে বললেন,
‘বাপের নাম খগেন? মোহিতর তো বাপের ঠিক নেই জানতাম, এ বাপটা কত নম্বর বাপ?’ হরিহর সর্দারের এই কথায় পুলক আর হৃদয়ও হ্যা হ্যা করে খুব হাসতে লাগল। পিছনে বসা হারানও হাসল খুক খুক করে। হরিহর সর্দার হাসি থামিয়ে নির্বিকার ভাবে বললেন,
‘সেদিন খুব ভোরে মোহিত এসে আমার কাছে সারেণ্ডার করেছিল। বলেছিল, হরদা বাঁচাও কিচ্‌ছু লুকোয়নি, সব কথা খুলে বলেছিল। তার ঘন্টা খানেক পরেই সকাল বেলা, জনার্দনদার ছেলে, তিনকড়ি এসে হাজিরহরদা মোহিতর ফাঁসি চাই’
 বছর আষ্টেক আগের এই ঘটনা নিয়ে গোটা রাজ্য জুড়ে বেশ তোলপাড় হয়েছিল। সে সব কথা আবার মনে পড়ে গেল। গেলাসে বেশ বড়ো একটা চুমুক দিয়ে হরিহরদা আবার বললেন,
‘মোহিত তখন এই বাড়িতেই ছাদের ঘরে ঘাপটি মেরেছে। হে হে হে হে। শালা তখন লাঠি খাওয়া নেড়ি কুত্তার মতো ভয়ে কাঁপছে, বুজেচিস? আর নিচেয় এই ঘরে তিনকড়ি খুব তড়পাচ্ছে, এই করেগা। এই মারেগা। শালা পালিয়ে যাবে কোথায়? বললাম, আমার কাছে এসব বলছিস কেন? জনার্দনদা আমাদের শোদ্দেয় নেতা। আর মোহিত একজন সাধারণ কর্মী। আমাদের দল এই সব নোংরা ব্যাপারে কাউকেই সমোত্থন করবে না, কিংবা পোশসয়ও দেবে না। কোন নোংরা রাজনীতিতেও অংশগোহণ করবে না। এটুকু গ্রান্টি। আর মোহিতর ফাঁসি দেওয়ার হলে, দেবে পোশাসন। মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দ্যাখ তিনকু, কোন রাজনৈতিক দল কাউকে ফাঁসি দিতে পারে কী?’ তিনকড়ির মাথা একটু ঠাণ্ডা হল। ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে বলল, তাহলে আমি এখন কী করবো, হরদা’? সকলেই একমনে হরদার কথা শুনছিল। হরদা একটু থেমে গেলাসে চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন,
‘আমি বললাম, জনার্দনদা আমাদের সকলের মাথার ওপরে ছাতার মতো ছিলেন। তিনি আর নেই, কিন্তু তাঁর বাকি কাজগুলো আমাদেরই তো শেষ করতে হবে নাকি? জনার্দনদার আদসশো, তাঁর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, সে কী আমরা ভুলে যাবো, বল? এখন মাথা গরম করার সময় নয়, তিনকুমাথা ঠাণ্ডা করে থানায় যা। আমি আগেই খবর পেয়ে বিকাশকে বলে রেখেছি, তুই গেলেই এফ আই আরের ব্যবস্থা করে দেবে। পোশাসনের কাজ পোশাসনকেই করতে দে, তিনকু। ওদের কাজে আমরা সব সহযোগিতা করবো। আমরাও কী চাই না, দোষী শাস্তি পাক? তুই এখন থানায় যা, থানার কাজ সেরে বাড়ি যা। তোর মা আর তোর পরিবারটা যেন ভেসে না যায়, সেটাও তোকেই সামলাতে হবে, তিনকু’!
গেলাস শেষ করে, হারানের দিকে খালি গেলাসটা আবার বাড়িয়ে দিলেন হরিহর সর্দার। এক মুঠো কিসমিস মুখে পুরে, প্লেটটা বাড়িয়ে দিলেন পুলকদের দিকে, বললেন,
‘কী রে? তোরা কিছুই নিচ্চিস না। কাজু, কিসমিস নে। হারান, দেখিস ওদের গেলাসও যেন খালি না থাকে। আমার কথা শুনে তিনকড়ি কিছুক্ষণ ভাবলো, একটু কান্নাকাটি করল। বলল, “তাহলে আমি আসছি হরদা, থানা থেকে ঘুরে আসি”? আমি বললাম, আয়। তবে বড়ো দাদা হিসেবে আরেকটা কথাও তোকে বলতে চাই। তোর ভালো লাগবে না কথাটা। কিন্তু এই তল্লাটে জনার্দনদার যা ইমেজ সেটাকে নষ্ট হতে দেওয়াটাও ঠিক হবে না, ভেবেই আমার বলা। তিনকড়ি বলল, কী কথা দাদা বলো না, বাবার পরে তোমাকেই আমরা বাবার মতো দেখি। আমি বললাম...’হরিহর সর্দার কথা বন্ধ করে হারানের হাত থেকে ভরা গেলাস নিলেন, বেশ বড়ো একটা চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,
‘আমি বললাম। তুই এখন বড়ো হয়েছিস। ভালোমন্দ বুজতে শিখেছিস। যে ভাবে, যে অবস্থায় জনার্দনদার লাশ পাওয়া গেছে, ল্যাংটো এক নষ্টা মেয়েছেলের সঙ্গে। সেটা নিয়ে যত ঘাঁটবি ততই দুর্গন্ধ বেরোবে। তাতে তোর, তোর পরিবারের, জনার্দনদার যে খ্যাতি, সুনাম – সে সব একদম মাটি হয়ে যাবে। সে কথাটাও কিন্তু মাথায় রাখিস। উপযুক্ত ছেলে হিসেবে তোর আবেগের সম্মান দিয়েই বলছি, বাবার সম্মান রাখাটাও কিন্তু খুব জরুরি। বাস, এই কথাতেই তিনকড়ির হাওয়া ফুস...বিচারের বাণী-টানি ঢুকে গেল ইয়েতে...’।

এক চোখ টিপে খিক খিক হেসে, হরিহর গেলাসে আবার একটা লম্বা চুমুক দিলেন। তাঁর জিভ এখন একটু জড়িয়ে আসছে। নেতা সুলভ গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্বের যে মুখোশ তিনি সর্বদা পরে থাকেন, সেটা সরে যাচ্ছেতিনি কিছুটা বাচাল হয়ে উঠছেন।
‘বাপের নাম খগেনকে নিয়ে কী যেন বলছিলি, পুলক?’
‘মোহিত তাকে গাঁ থেকে তুলে এনে নিজের কাছে রেখেছে’।
‘হুঁ? বাপের সুপুত্তুর হইতে বংশের গৌরব বাড়ে। ছোটবেলায় কোতায় যেন পড়েছিলাম। আগে শ্লা ওই বাপটাকে তোল। তুলে এনে খুব হড়কা। এমন হড়কাবি খগেনের বাপের নামও যেন খগেন হয়ে যায়। হে হে হে হে। লোকটা কেমন? চিনিস? মোহিতর মতোই হেক্করবাজ?’
‘না, না। হরদা। একদম মিয়োনো মুড়ির মতো। ভিতু আর হেগো রুগী। এক ধমকেই কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যায়’। গেলাসের প্রায় অর্ধেক শেষ করে হরিহর বললেন,
‘অমন বাপের এমন ছেলে হয় কী করে বাওয়া? হে হে হে হে। যাকগে যাক, ওসব পরের ঘরের কথা নিয়ে আমাদের কাজ কী? বাপটাকে দিয়ে পুলিশের কাছে সেদিনের সেই ঘটনার বয়ান দেওয়ানোর ব্যবস্থা কর। তারপর মোহিতকে আমি দেখছি। এমন কেস দেব না? ব্যাটা একদিনের জন্যেও জামিন পাবে না। তদন্ত চলবে, বিচার চলবে। আইন আইনের পথে চলবে.এ.এ.এ। শালাকে পনের বছর জেলের ভাত যদি না খাইয়েচি, তো আমার নাম হরিহর সর্দার নয়’।
হরিহরের এখন ঘাড় টলছে। দু হাত ছড়িয়ে পিছনের দিকে ভর দিয়ে বুক চিতিয়ে বসে, পা দুটো ছড়িয়ে দিলেনতারপর খুব রসিয়ে রসিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে লাগলেন,
‘মোহিতর বাপকে বুজিয়ে বোলবি, বুয়েছিস? খিক...খিক...খিকতোমার অমন সতী নক্কী বউটা জনার্দনের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতে না হয় গিয়েইছিল, তাই বলে শিলপাটা ঠুকে দুটোকেই মেরে ফেলতে হবে? তাও এক্কেবারে...খিক-খিক-খিক...শঙ্খলাগা মুহূত্তে? অ্যাঁ? এত কীসের তাড়া ছিল, হে? এট্টু অপেক্ষা করলে কী হত? ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা...মেল ফিমেল ওয়ানটু। দুটোই মরল ন্যাংটুউউউ’! হরিহর থেমে ঘাড়টা সোজা করল, চোখদুটো বড় বড়ো করে পুলকদের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
‘আর একটা কতা। যদি ইন কেস, মোহিতর বাপটা রাজি না হয়, তাহলে কী করবি?’
পুলক এবং হৃদয় কিছু বলল না, নেশাগ্রস্ত হরিহরের দিকে তাকিয়ে রইল চুপ করে।
‘যদি ইন কেস মালটা রাজি না হয়, তাহলে কিন্তু মোহিত শেষ। ব্যাটা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলবে গাছের ডাল থেকে। পাপের বেতন মিত্ত্যু। ইস্কুলে পড়িসনি? কটা বাজলো রে, হারান’?
‘আজ্ঞে সাড়ে বারোটা বাজতে চলল’।
‘ওই শ্লা। এত রাত হয়ে গ্যাচে? তোরা তবে আয়। আমি ওপরে যাই। কাজ সেরে আমায় রিপোর্ট দিবি। কোন এক্সটা কিচাইন যেন না হয়। হৃদয়, মনে থাকে যেন’।
এর পর হরিহর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন গদির ওপর, বললেন, 
‘শালা বেজম্মা। জীবনে কোনদিন স্কুলের দরজা কোনদিকে দেখল না, সে এখন বড়ো নেতা হয়ে,  আমার ওপর ছড়ি ঘোরাবে? আমি হরিহর সর্দার, আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনেছিলাম তোকে, ভুলে গেলি হারামজাদা? হারান, আরেকটা দে তো ছোট করে। এটাই লাস্ট। তবে বুজলি হারান, ছেলেটার এলেম আছে। এই কবছরে তরতরিয়ে শিখে নিল সব। কথা, বার্তা, মিটিংয়ের লেকচার, শুনলে কে বলবে, যে ব্যাটা ক লিখতে কলম ভাঙে? মালটাকে এখনই খালাস করতে না পারলে, আমিই না খালাস হয়ে যাই’
পুলক উঠে দাঁড়াল, সঙ্গে হৃদয়ও। পুলক বলল,
‘আমরা এখন চলি, হরদা’? হরিহর সর্দার কোন সাড়া দিল না দেখে, ওরা বেরিয়ে এল ঘর থেকে।      



এই যে এত আরাম। এত বিলাসিতা। চারবেলা করে খাওয়া। মাছ, মাংস ডিম। জেলাবি, রসগোল্লা, সন্দেশ। এত ঠাট ঠমক। এ কদিনে খগেন তাও কেন হাঁফিয়ে উঠছে! বিয়ে বাড়ির হৈ চৈ লোকজন আসা যাওয়া মিটে গিয়ে, উথলে ওঠা জীবনটা যখন থিতু হয়ে বসল, খগেন দেখল সে এই বাড়িতে প্রায় বন্দী! মোহিতের কড়া নিষেধ একা একা কোথাও বেরোনো যাবে না। মাঠে ঘাটে আদাড়ে পাদাড়ে অকারণে ঘুরে বেড়াতে অভ্যস্ত লোকের কাছে, সারাদিন ঘরে বসে থাকাটাও কম যন্ত্রণার নয়বাইরে বেরোতে গেলেই দুজন ছোকরা তাকে বগলদাবা করে, বাইকে চাপিয়ে নিয়ে বেরোয়এ সব কী ভালো লাগে নাকি? প্রত্যেক দিনের মতো আজও সকাল সকাল ঘুম ভেঙে উঠে, সব কাজকম্ম সেরে চুপ করে বারান্দায় বসেছিল খগেন। টুকরো আকাশ আর গাছপালার দিকে তাকিয়ে, মনমরা হয়ে ভাবছিল, মোহিতকে বলবে, কটা দিনের জন্যে আমাকে গাঁয়ে রেখে আয় মোহিত। মোহিত রাজি হবে বলে মনে হয় না। বলবে, ‘গাঁয়ে খেতে পাও না, শুতে পাও না, সেকেনে তোমার কী মোদু আচে শুনি?’ এ কথার কোন জবাব নেই খগেনের কাছে। বৌটাও খুব আত্মীসূয়ো। খগেনকে খুব বাবা, বাবা বলে। ছেদ্দা ভক্তি করে, যত্ন আত্তি করে। সেও যদি বলে, ‘কার জন্যি আমাদের ছেড়ে যাচ্চো, তুমি’? কী উত্তর দেবে খগেন? এই সব যতই চিন্তা করছিল, ততই তার মনে হচ্ছিল, গাঁয়ে ফেরা অসম্ভব। কিন্তু মন যে মানছে না। সুখের ঘরের বন্ধ দোরে, বার বার ক্যানে এসে ধাক্কা দিচ্ছে দুখের জেবন! বহুদিন আগে কোন কীর্তনের আসরে কিংবা পালা গানে শুনেছিল “সুখেরও লাগিয়ে যে করে পীরিতি, দুখ যায় তারই ঠাঁই”। এই দুটো আখরই তার মনে আছে। এই দুটো আখর সে গুনগুন করে ভাঁজতে লাগল আপনমনে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। খগেনও আজকাল গান গাইছে? অবাক কাণ্ড বটে!

সদর দরজায় হঠাৎ জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ আর মোহিতের নাম ধরে বেশ কয়েকজন ডাকাডাকি করছে। খগেনের পেটের ভেতরটা হঠাৎ গুরগুর করে উঠল। দড়িতে শুকোতে দেওয়া গামছাটা কোমরে জড়াতে জড়াতে সে দোতলার বারান্দা থেকে মোহিতের গলা শুনতে পেল।
‘কে রে, কে? কী হয়েছে? ও পুলক? কী হয়েছে রে? কোন গণ্ডগোল’?
‘মোদ্দা, একটু নিচে আসবে? জরুরি কথা আছে’
‘কী কথা বল না!’
‘এভাবে বলা যাবে না। নিচেয় এসো না একবার’।
‘আসছি, দাঁড়া’।
মোহিত ঘরে এসে লুঙ্গির ওপর একটা টি শার্ট গায়ে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা আঁচড়ে দেখে নিল চেহারাটা। শম্পা, মোহিতের বউ জিগ্যেস করল,
‘কী হয়েছে, গো? এত সকালে এসে পুলকদা এত চেঁচামেচি করছে কেন?’ মুচকি হেসে মোহিত বলল,
‘এ সব পলিটিকের খেলা। ও সব তোমার না বোঝাই ভালো। আজ ভোরে হরদা মাডার হয়েছে। খবর পেয়ে তাই দৌড়ে এসেচে’। শম্পা আতঙ্কে শিউরে উঠল, উত্তেজিত হয়ে বলল, 
‘হরদা মাডার হয়েছে? বলো কী গো? আর তুমি চুপ করে বসে আছো? তোমাকে কতো ভালবাসত। এই সেদিনই আমাদের বিয়েতে এসে কত কথা বলল। বলল, “শম্পা তোমার হাতে একটা খ্যাপা ঘোড়া তুলে দিলাম, তাকে বাগ মানাতে হবে”! আর আজ মাডার?’ মোহিত নির্বিকার ভাবে বলল,  
‘বললাম যে পলিটিকের খেলা। আমি আসচি, কী বলে দেকি’।
পুলক এবং তার দলবল অধৈর্য হয়ে উঠছিল। খবরটা এতই জরুরি। মোদ্দা গুরুত্বটা বুঝতে পারছে না। মোহিত ধীরে সুস্থে নিচেয় নেমে, সদর দরজা খুলল,
‘আয়, ভেতরে আয়’। ভেতরের বারান্দায় ঢুকেই পুলক বলল,
‘মোদ্দা, হরদা মার্ডার হয়েছে’।
‘কি বলছিস? কখন? কী ভাবে? কারা করল, কোন খবর পেয়েছিস?’
‘ভোরে হরদা রোজ হাঁটতে যায়, বকুলতলা পার্কে। পার্কের গেটের মুখে দুটো ছেলে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হরদা কাছাকাছি যেতেই পেছনের সিটে বসা ছেলেটা পাঁচ রাউণ্ড ফায়ার করেছে দুটো পেটে, একটা গলায়, একটা কানে। হরদা পড়ে যেতেই, সামনের ছেলেটা বাইক নিয়ে চম্পট!’
‘সিকিউরিটি কেউ ছিল না? সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি?’
‘নিয়ে গেছিল, সদানন্দ জেনারেলে। গাড়ি যোগাড় করতে দেরি হয়েছিল একটু। হাসপাতালে নেওয়ার পর বলল, ডেড, কিছু করার নেই। বলছে কান আর গলারটাই...’
‘পোস্টমর্টেম হবে তো? তোরা হাসপাতালে যা। যত তাড়াতাড়ি পারিস, হরদাকে বের করে আন। হাসপাতাল থেকে মিছিল করে, পার্টি অফিসে নিয়ে যাবো। সেখানে সারাদিন হরদা থাকবেন। তারপর বিকেলের দিকে আমরা শ্মশানে নিয়ে যাবো’।
‘ঠিক আছে, মোদ্দা’
‘বাকিরা কোথায়? হৃদয়, তপন, বিজন, মলয়, তরুণ?’
‘হৃদয় থানায় আছেবাকিরা হাসপাতালে’
‘হুঁ। ঠিক আছে, সুমনবাবুর সঙ্গে আমি কথা বলছি’হাসপাতালের সামনে পাণ্ডে চকে আমরা একটা পথসভা করবো, তার ব্যবস্থা কর। আমি আধঘন্টার মধ্যে আসছি। কলকাতাতেও একবার ফোন করতে হবে। এখনই বেরিয়ে পড় - অনেক কাজ, সময় নেই!’
পুলকরা বেরিয়ে যাওয়ার পর, সদর দরজা বন্ধ করে দিল মোহিত। পিছন ফিরে দেখল খগেন দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। একটু হেসে বলল,
‘বাবা, আমি না বলা পর্যন্ত, তুমি কিন্তু কোত্থাও বেরোবে না...। তোমার যা দরকার শম্পাকে বলবে, ও আনিয়ে দেবে’। তারপর তড়তড়িয়ে উঠে গেল দোতলায়। ঘরে ঢুকে টি শার্ট খুলতে খুলতে শম্পাকে বলল,
‘চট করে খাবার দাও তো। সারা দিন কপালে কিছু জুটবে কী না, কে জানে?’
‘দুপুরে খেতে আসবে না’?
‘পাগল হয়েছো? আজ সারাদিন একদম টাইম পাবো না। ফিরতেও রাত হবে। সেই শ্মশান থেকে ফিরবো’
‘শোনো না। গাড়িটা সময় করে একবার পাঠিয়ে দিও, টিফিন কেরিয়ারে পাঠিয়ে দেবো’।
‘সেটা খারাপ বলো নি। তবে, মাছ – মাংস কিছু দিও না। পাব্লিক দেখলে নজর দেবে। ডিম চলতে পারে। আমি চান করতে ঢুকছি, তুমি বেকফাস্ট রেডি করো। ও হ্যাঁ, সাদা পাজামা আর কলার দেওয়া সাদা পাঞ্জাবিটা বের করে রাখো, চান করে ওটাই পরবো’।  

      
  
‘বন্ধুগণ, আজ আমরা ভয়ংকর এক সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ, নীতি-দুর্নীতির কোন বাছবিচার নেই। ক্ষমতার লোভ আর ছোট ছোট স্বাত্থের নেশায় আমরা কী মনুষ্যত্ব ভুলে যাচ্ছি? আমরা চিরকাল গণতান্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি, শাসকপক্ষ – বিরোধীপক্ষ, গণতন্তের দুই স্তম্ভ। কিন্তু নীচ ঘৃণ্য কিছু রাজনীতিক যারা যে কোন উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়। তারা বারবার অশান্তি আর সন্তাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এসব তাদের হতাশার লক্ষণ, তারা জানে তারা কোনদিনই সফল হতে পারবে না। যার ফলে এই এলাকার সব থেকে শোদ্ধেয়, সমাজের বন্ধু, যিনি আমাদের সমস্ত দুঃখে বিপদে আমাদের সকলের মাথার ওপর ছাতার মতো ভরসা জুগিয়েছেন, তিনি আজ নিহত। তাঁর নিশংস এই মিত্যুর জন্যে দায়ী কে? পোশাসনের কাছে আমাদের দাবি, অবিলম্বে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তদন্ত করতে হবে কারা কারা আছে এই ষড়যন্তের পিছনে?
বন্ধুগণ, আমরা কিন্তু ভয় পাইনি। আমরা পিছিয়ে যাবো না। সত্যের জন্যে ন্যায়ের জন্যে আমাদের এই লড়াই থেমে থাকবে না। বিরোধীদের এই জঘন্য চক্কান্ত আমরা ভাঙবোই। দেশ থেকে এই সব জঘন্য নিশংস পিশেচদের নিকেশ না করা পর্যন্ত আমাদের এই লড়াই চলতেই থাকবে। হরিহরদা আমার বড়ো ভাইয়ের মতো ছিলেন। তাঁর এই অকাল পয়াণে, আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কাজেই আজ আর বেশি কিছু বলে আপনাদের সময় নষ্ট করবো নাশেষ করার আগে, আমি শুধু বলতে চাই, বন্ধুগণ আজ হিংসার দিন নয়  কোন পোরোচনায় পা দেবেন না। গুজবে কান দেবেন না। হিংসার বদলা হিংসা আমরা চাই না। হিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করা যায় না। আমরা শান্তিপূন্নভাবে মিছিল করে হরিহরদার প্রতি শেষ শোদ্দা জানাবো। আমরা এই সন্তাসের মোকাবিলা করবো রাজনৈতিক ভাবে। জয় হরিহরদা। হরিহরদা তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলবো না। হরিহরদা অমর রহে’।
মোহিতের উদাত্ত বক্তৃতায় সমবেত জনতা আপ্লুততারা মোহিতের সঙ্গে একসঙ্গে গর্জন করে উঠল, হরিহরদা অমর রহে। হরিহরদা তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলবো না। অস্থায়ী মঞ্চ থেকে নেমে এল মোহিত। পিছনে একটা মেটাডোর গাড়ি সাদা কাপড়, ফুল আর অজস্র ধূপ দিয়ে সাজানো। মাঝখানে  লোহার খাটের ওপর স্ট্রেচারে হরিহরদার মরদেহ। সাদা চাদরের ওপর ফুলে ফুলে ঢাকা। দুই নাকের ফুটোয় তুলো দেওয়া না থাকলে মনে হত, হরিহরদা ঘুমোচ্ছে। তরুণ আর মলয়কে মোহিত ইশারা করল গাড়ি এগিয়ে নিয়ে আসার জন্যে। তারপর মোহিত নিজে মিছিলের সামনে এগিয়ে গেল। তার দুপাশে রইল তার দলের মাঝারি নেতারাতার পরনে সাদা পায়জামা, গুরুশার্ট, পায়ে সাদা স্নিকার্স। বুকের কাছে ছোট্ট কালো একটা ব্যাজ। সকলে প্রস্তুত কিনা একবার দেখে নিয়ে, হাতের ইশারা করে চিৎকার করে বলল, ‘সন্তাসবাদীদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’তারপর  একসঙ্গে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল পার্টি অফিসের দিকে, যেখানে হরিহর সর্দারের মরদেহ শুইয়ে রাখা হবে। তাঁর গুণগ্রাহী ভক্তদের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
মিছিল চলতে শুরু করলমেটাডোর হরিহর সর্দারের মরদেহ নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তাকে ঘিরে মিছিলের লেজ চলে গেছে অনেক দূর। মোহিতের আন্দাজে হাজার ছয়-সাত লোক তো হবেই, আটও হতে পারে। মোহিতের চেহারায়, আচরণে আজ অদ্ভূত পরিবর্তন। এ তল্লাটে হরিহর সর্দারের পর সেই যে অবিসংবাদিত নেতা, উপস্থিত জনতার মনে এ নিয়ে কোন দ্বিধা নেই। মিছিলের সামনে একটা পুলিশের জিপ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। থানার বড়ো এবং মেজবাবু হেঁটে চলেছেন মিছিলের আগে। তাঁরা গতকাল পর্যন্ত মোহিতকে মোহিতবাবু বলতেন, আজ সকাল থেকে বলছেন, স্যার। বেশ কয়েকজন কন্সটেবলও রয়েছেন, তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে সতর্ক লক্ষ্য রাখছেন। মোহিতের আজ ম্লান মুখ, আজ সকালে সে দাড়িও কামায়নি। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। হরিহরদার মৃত্যুতে সে যেন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। জোড়হাত করে দুপাশের রাস্তার ধারে, দোকানের সামনে, বাড়ির জানালায়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ ও মহিলাদের নমস্কার করছে। মাঝে মাঝে হাত নাড়তে নাড়তে বলছে ‘হরদা, তোমায় আমরা ভুলছি না ভুলবো না’। পিছনের মিছিল গর্জে উঠছে একসঙ্গে।
কিলোমিটার দুয়েক চলার পর, মোহিত দুপাশে পুলক আর হৃদয়ের কাঁধে হাত রাখলযেন খুব ক্লান্ত। পার্টি অফিস পৌঁছতে আরো প্রায় দেড় দু কিলোমিটার বাকি। মিছিলের গর্জনের মধ্যেই মোহিত চাপা স্বরে বলল,
‘কোথা থেকে কী যে হয়ে যায়, ভগবানই জানেন। কাল রাত সাড়ে বারোটার সময় তোরা যখন হরদার বাড়ি থেকে বেরোলি, তখন কেউ ভাবতে পেরেছিলি, আজ এমনটা হবে?’ পুলক আর হৃদয় দুজনেই শিউরে উঠল। তাদের দুজনেরই মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল, মোহিতের সেটা নজর এড়াল না ‘তুই, হৃদয়, আমি, কত দিন, সন্ধে, সারারাত, হরদার ওই বৈঠকখানায় কাটিয়েছি, বল? সেই হরদা বলল “মালটাকে এখনই খালাস করতে না পারলে....” কথাটা শেষ করল না মোহিত। ঘাড়ে ঝাঁকানি দিয়ে মিছিলের সুরে সুর মিলিয়ে বলল, ‘হরদা আমরা তোমায় ভুলছি না। ভুলবো না। ভুলবো না ভুলবো না’। তারপর গলা নামিয়ে বলল ‘ভুলবো না রে, পুলক তোকেও না, আর তোকেও না, হৃদয়ভুলবো না’ দুজনেরই শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এল শীতল আতঙ্কের স্রোত। মৃত্যুর মিছিল এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে।
--০০--