(দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত)
চ্যালেঞ্জ একটা ছিল, কিন্তু সে কথা পরে।
রোববার
সকালের বাজারটা নিজে হাতে না করলে, প্রাণপণবাবু ঠিক আরাম পান না। ভোজনরসিক মানুষ, সারা সপ্তাহ কাজের চাপে একদমই
সময় পান না। রোববারেও কী আর ফুরসুত নেবার জো আছে? নেই, তবু তার মধ্যেই সময়টা বের
করে নেন। বাজারে যাবার সময়, কাজের ছেলে প্রতাপ তাঁর সঙ্গে থাকে। বাজারের থলে বওয়ার
কাজটা প্রতাপই করে। কাজের দিদি, কাজের মাসি, বলার রেওয়াজ থাকলেও, কাজের ছেলে বলতে
কিন্তু করিৎকর্মা ছেলে বোঝাতো। প্রতাপ কিন্তু সত্যিই কাজের ছেলে। সর্বদা পেছনে
পেছনে থাকে। কচি আর টাটকা আনাজ চেনে। তাজা
মাছের কদর জানে। চাঙ্গা চিকেনের চোখ চেনে। কোন কিছু পছন্দ হলেও প্রাণপণবাবু ঝুপ
করে কিনে ফেলেন না। প্রতাপের সাজেসান নেন। দরদস্তুর, সুলুকসন্ধান, ফিকে রঙ, গাঢ় রঙ সব দিক বিচার করে,
প্রতাপের সঙ্গে যুক্তি সেরে তিনি থলিতে জিনিষ তোলেন। হুঁ হুঁ, এ তল্লাটে দুঁদে
উকিল হিসেবে তাঁর নাম অমনি অমনি প্রতিষ্ঠা পায় নি। অনেক পরিশ্রম, সাধনা, অধ্যবসায়,
একাগ্রতা...সে আরও অনেক কিছু। মদনতলা বিন্দুবাসিনীদেবী
বুনিয়াদি উচ্চ বিদ্যালয় সেবারে প্রাণপণবাবুকে সম্বর্ধনা জানিয়েছিল। সেখানে সেই
বারো ক্লাসের ছেলেটি বেড়ে বলেছিল তাঁর সম্পর্কে। যদিও নিজের কথা ঢাক পিটিয়ে
সাতকাহন বলার লোকই নন তিনি।
আজ
প্রতাপ নেই। জরুরি কাজে বাড়ি গিয়েছিল, বলেছিল শনিবার রাত্রে ফিরে আসবে।
ফেরেব্বাজটা ফেরেনি, আজ সকালেও না। বেলা নটা অব্দি অপেক্ষা করে প্রাণপণবাবু
একাএকাই বেরোলেন। কারও জন্যে তাঁর কাজ আটকে থাকবে নাকি?
মাছের
বাজারে আজ ইলিশ উঠেছে বিস্তর। দেখে তো ভালই মনে হচ্ছে, তাদের গায়ে স্নিগ্ধ এলইডি
আলোর রূপোলী ঝলক। ওজনও মন্দ নয়, সাড়ে আটশো নশো তো হবেই। দরও এমন কিছু বেশি নয়,
মাত্র চোদ্দশ টাকা। প্রাণপণবাবু ভালো জিনিষের কদর বোঝেন, দরদামে পেছপাও হন না। এ
কটা টাকা তাঁর মিনিট দশেকের রোজগার, কাজেই টাকাটা কোন ফ্যাক্টর নয়। তবে কেনার আগে
প্রতাপের সঙ্গে একটু শলাপরামর্শ করতে পারলে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন, আজ সে উপায়
নেই।
‘ইলিশ
নিচ্ছেন নাকি?’ পেছন থেকে কেউ একজন বলল। প্রাণপণবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, দাড়িগোঁফে
মোড়া এক ছোকরা, হাসি হাসি মুখে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। সে আরও বলল,
‘কোয়ালিটি
মন্দ নয়, কোলাঘাটের টাটকা ফসল। তবে দরটা একটু বেশিই। যদি নেবেন বলে মনস্থির করে
ফেলেন, তাহলে আমি একটু দরদাম করে দেখতে পারি’। প্রাণপণবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
লোকের মুখে শুনেছেন, তাঁর এই চাউনিতে অনেক বাচাল সাক্ষীও কথা হারিয়ে ফেলে। বিরোধী
পক্ষের ঘুঘু উকিলও আইনের মার প্যাঁচ ভুলে, পায়রার মতো বাজে বকবকম করে। কিন্তু এ
ছোঁড়াটা হার মানল না, হাসি হাসি মুখে তাকিয়েই রইল প্রাণপণবাবুর দিকে।
‘আপনি
আমাকে চেনেন?’
‘বিলক্ষণ।
মদনতলায় আমার যদিও বেশিদিন হয়নি, তবে, আপনাকে চেনে না, এমন কাক পক্ষীও এ তল্লাটে
আছে বলে আমার মনে হয় না। আর আমার মতো সামান্য এক ফচকে ছোঁড়াকে আপনার মতো মানুষের
আপনি-টাপনি বলাটাও কী উচিৎ হচ্ছে, স্যার?’ ছোঁড়ার কথাবার্তা ভালই লাগল
প্রাণপণবাবুর, ছোকরার বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, কথাবার্তার ধরন ধারণে মানী লোকের যে মান
দিতে হয়, সেটা জানে। তিনি জিগ্যেস করলেন,
‘কী
করা হয়? নাম কী? তোমাকে তো চিনতে পারলাম না?’
‘হে
হে, আমাকে না চেনাটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। তবে সে সব পরে হবে, স্যার। ইলিশ যদি
পছন্দ হয়ে থাকে, চটপট তুলে নিন স্যার। আজকাল মদনতলায় হাবিজাবি কাঁচা পয়সাওলা লোকের
আনাগোনা খুব বেড়েছে। আঙুল ফুলে কলাগাছ সে সব বারফট্টাই বাবুরা আপনার মতো
গণ্যিমান্যি লোকের সম্মান বুঝবে না। শেয়াল কী আর বাঘসিংহের বনেদিয়ানা বুঝবে,
স্যার?’ প্রাণপণবাবু কিছুটা অভিভূত হয়ে পড়লেন ছোঁড়ার কথায়, তিনি একটু ভরসা করে
বললেন,
‘মাছটা
খারাপ নয়, নেওয়া চলতে পারে, বলছো?’
‘নিশ্চিন্তে
নিতে পারেন, স্যার। তাহলে কথা বলি?’ মাছওয়ালার পাল্লায় চারটে বড়ো বড়ো ইলিশ তুলে
দিয়ে ছোকরা বলল,
‘কত
হয় দেখো তো হে?’ প্রাণপণবাবু হৈ হৈ করে
বললেন,
‘করো
কী হে? অত মাছ কে খাবে?’
‘সামান্য
একটু বেশি হবে, তা হোক। আপনার মতো ছোট
পরিবারে দুটো হলে টানাটানি হয়। তিনটে হলে ঠিক হয়, কিন্তু ওদিকে আবার তিনে শত্রু হয়
– মা ঠাকুমার মুখে শুনেছি। কাজেই চারটে ঠিক হবে স্যার। ভাজা, সরষেঝাল, ভাপা,
কালোজিরে ফোড়নের ঝোল। আপনারা মাছের টক খান নাকি, স্যার? পুরোনো তেঁতুল দিয়ে ইলিশের
মুড়ো দিয়ে টকমিষ্টি অম্বল, খেয়ে দেখবেন, স্যার। কুলকুচি করলেও স্বাদ যায় না, মুখে
বেশ কিছুদিন লেগে থাকে’।
‘সে
ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে এত? না না, দুটো নামাও’।
‘ওইটি
বলবেন না স্যার? এই ইলিশ কী আপনি সারা বছর পাবেন? এ কী একঘেয়ে কাটাপোনা? সারা বছর,
একই দাম, একই স্বাদ? অনেকে জোড়া জোড়া ইলিশে তেল সিঁদুর লাগায়, নাকে নথ পরায়। বলে
ইলিশ ঘরের লক্ষ্মী। কত হল হে?’ শেষ কথাটা মাছওয়ালাকে জিগ্যেস করল ছোকরা। মাছওয়ালা
বলল,
‘তিন
কিলো সাড়ে তিনশো’
‘অ্যাঃ,
আবার সাড়ে তিনশো, ওই তিন কিলোই ধরো! ছানি কুচোনো না করে, বড়ো বড়ো পিস করবে ভাই।
মুড়োয় শাঁস রাখবে না। তেলটেলগুলো ভালো করে পরিষ্কার করে দেবে। একটু চা বলবো,
স্যার? একটু তো সময় লাগবেই’।
‘কিন্তু
এতো অনেক টাকা? আমি অত আনিনি তো!’
‘দুশ্চিন্তা
করছেন কেন, স্যার? যা এনেছেন, তাতে আরামে হয়ে যাবে’। এবার প্রাণপণবাবু বেশ বিরক্তই হলেন, একটু ঝেঁজে বললেন,
‘আমি
কত এনেছি, তুমি কী করে জানলে হে? তোমাকে ভাল মনে করেছিলাম, তুমি তো আচ্ছা বেয়াদব
ছোকরা ! শুধু মাছ কিনলেই হবে, বাকি আর বাজার নেই?’
‘স্যার,
স্যার স্যার, প্লিজ, প্লিজ উত্তেজিত হবেন না, স্যার। আপনার মতো মানুষের উত্তেজনা
মানায় না। বাজারের জন্যে আপনি নিশ্চয়ই পাঁচ নিয়ে এসেছেন, এ ছাড়াও মানিব্যাগ ঘাঁটলে
পাঁচ-সাতশ তো হয়েই যাবে। মাছের জন্যে তিন দিলে দুই থাকবে। দুই দিয়ে আপনার বাকি
বাজার হবে না, স্যার? মাগ্যির বাজারে জিনিষপত্রের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এতটাও
কী বেড়েছে স্যার? ওই চা এসে গেছে স্যার, চিনি ছাড়া, চা খান। রোববারের বাজারটা এনজয় করুন স্যার, অযথা উত্তেজনায় শরীরকে
বিপদে ফেলবেন না’। ছোকরার এলেম আছে, প্রাণপণবাবুর মতো দুঁদে উকিলকেও ক্ষণে ক্ষণে
অবাক করে দিচ্ছে। চায়ে হালকা চুমুক দিয়ে প্রাণপণবাবু বললেন,
‘সাড়ে
চারের মাছ, তিনে রাজি হয়ে যাবে? কী বলছো হে? তুমি কী এখানকার দাদা, না তোলাবাজ? এ
তল্লাটের সব দাদাদের আমি চিনি, কিন্তু তোমাকে তো নতুন চিনছি হে! তার ওপর, আমার
কাছে কতটাকা আছে, চিনি ছাড়া চা খাই, এত খবরও রয়েছে তোমার কাছে। তোমার মতলব মোটেই সুবিধের
ঠেকছে না। তবে এও বলে রাখছি আমিও কিন্তু খুব সুবিধের লোক নই। ’
‘হে
হে, বদ মতলব নিয়ে কোন লোক আপনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে, এ আশা ঘুণাক্ষরেও করি না,
স্যার।
একবার দেখে নেবেন, পিসগুলো ছোট হচ্ছে না তো, স্যার? এর থেকে বড়ো করলে,
মাছের ভেতরে তেলনুনমশলা ঢুকবে না। পানসে কাঁচা লাগবে। আবার ছোট করলেও খেয়ে ঠিক
তৃপ্তি হয় না, কাঁটা বাছার খাটনিই সার হয়, স্যার’।
চায়ের
ভাঁড়টা খালি করে পচা আনাজের ডাব্বায় ছুঁড়ে ফেললেন প্রাণপণবাবু। আর ছোকরার ইলিশ
খাওয়ার তরিবত শুনে, তিনি মনে মনে খুশি হলেন ঠিকই, তবে ছোকরার মতলব নিয়ে, তাঁর মনের
সন্দেহটা গেল না। আবার এও মনে হল, মদনতলা ছোট শহর হলেও, এই শহরে তাঁর নাম আর দাপটেই
তো এ সব অসম্ভব সম্ভব হচ্ছে! এটা ভেবেও তাঁর মনে একটু শ্লাঘা হল। এরপর তাঁর নামে,
বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায় বললেও খুব একটা বাড়াবাড়ি হবে না, নিশ্চয়ই! পকেট থেকে তিন
হাজার গুনে তিনি ছোকরার হাতে দিয়ে বললেন,
‘দরদাম
যা করার তুমিই করো হে, আমি আর ওসবের মধ্যে নেই’।
প্লাস্টিকের প্যাকেটে কাটা ইলিশ নিয়ে, প্রাণপণবাবুর
মাছের ছোট থলিতে ভরতে ভরতে ছোকরা বলল,
‘ছি,
ছি। এ আবার একটা কথা হল? আপনার সঙ্গে আবার দরদস্তুর কী? আপনি নিজে হাতেই টাকাটা
দিন স্যার। আপনার মতো ব্যক্তির হাতে ঈপ্সিত জিনিষ তুলে দিতে পেরে, ও কী কম আনন্দ
পাচ্ছে স্যার?’ আজকাল ছোকরারা যাকে গ্যাস
খাওয়ানো বলে, তাঁদের সময় সেটাকেই তেলদেওয়া বলা হত। এসব বুঝেও, প্রাণপণবাবু
মাছওয়ালা ছোকরার হাতে টাকা দিয়ে একটু হাসলেন। ছোকরা টাকা কটা গুনলোও না বরং করজোড়ে
নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে এমন হাসল, কানদুটোও এঁটো করে ফেলল হতভাগা! প্রাণপণবাবু মোহিত
হয়ে, গদগদ স্বরে জিগ্যেস করলেন,
‘এখন
তো শীতের সময় নয়, তা তোমার এই ঈপ্সিত ব্যপারটা কি হে’?
‘ছাড়ুন
না স্যার। মুখ ফস্কে এক আধটা কথা অমন বেরিয়ে যায়। সব কথা কী স্যার অমন ধরতে আছে?
তখন আমার নাম জিগ্যেস করছিলেন, আমার নাম মানস ভূষণ দাস। লোকে ভালোবেসে ভুষি বলে।
খুব খারাপ কিছু বলে না। একে ইঞ্জিনিয়ারিং, তারপরে আবার ম্যানেজমেন্ট - এই সবে শেষ করলাম কী না করলাম, একটা চাকরিও
পেয়ে গেলাম স্যার। এখন কদিন ছুটি, ফাইন্যাল রেজাল্টটা বেরোলেই, নতুন চাকরিতে জয়েন।
বিদেশ বিভুঁই কোথায় চলে যাবো স্যার, কবে আবার ফেরা হবে তাও জানি না। তাই বাড়ি এসে
আপনাদের মতো সজ্জনের সেবা করে একটু আনন্দ পাওয়া, স্যার। মা কালীর দিব্বি স্যার, এ
ছাড়া আর কোন বদ মতলব নেই’।
‘ঠিক
আছে, ঠিক আছে। কদিন রয়েছো তো? সময় করে একবার এসো না আমাদের বাড়ির দিকে। ভালো করে
আলাপ করা যাবে’।
‘নিশ্চয়ই
যাবো স্যার। এখন আপনি অন্য বাজার করবেন তো, স্যার? আপনি করুন, আমি কাছাকাছিই
থাকবো। কোন সাহায্য দরকার হলেই, হাঁক দেবেন চলে আসবো’।
******
প্রাণপণবাবুর
বাজার শেষ হতে ঘন্টাখানেক লেগেই গেল, মাছের থলি ছাড়াও ভরে উঠল দু দুটো থলি। বাজার
থেকে বেরিয়ে রিকশার জন্যে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন, প্রাণপণবাবু। ব্যাটারা রোববার
হলেই কোথায় যে ডুব মারে! অন্যদিন ঘাড়ের পাশে এসে প্যাঁক প্যাঁক করে, কান ঝালাপালা
করে দেয়। আজ কারও পাত্তা নেই! ভুষি হঠাৎ কোথা থেকে যেন উদয় হল, বলল,
‘স্যার
রিকশা খুঁজছেন? মানুষ বিপদে পড়লে, কিংবা
অসহায় অবস্থায় পড়লে, ওদের দেখা মিলবে না, স্যার। কত আর দূর? আমাকে দুটো ব্যাগ দিন,
আপনার বাড়ি অব্দি পোঁছে দিয়ে আসি’। প্রায় জোর করেই ভারি থলিদুটো প্রাণপণবাবুর হাত
থেকে নিয়ে নিল ভুষি। তারপর বলল,
‘আপনি
ওই আমিষথলিটা নিজের কাছেই রাখুন স্যার। খুব ভারি মনে হচ্ছে না তো?’
‘আরে
না না, তুমি বারবার কিন্তু খুব বিড়ম্বনায় ফেলছো, মানস’।
‘ভুষি
বললে বেশি আনন্দ পাবো স্যার। খুশীও’। আর
কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে ভুষি দু হাতে থলি নিয়ে হন হন করে হাঁটা দিল প্রাণপণবাবুর
বাড়ির দিকে। প্রাণপণবাবুও অগত্যা মাছের থলিটা নিয়ে ভুষির সঙ্গ নিলেন।
‘ইঞ্জিনিয়ারিং
কোথায় পড়েছ, ভুষি?’
‘আজ্ঞে
সে তেমন বলার মতো কিছু নয়, কানপুর আইআইটি’।
‘বলো
কী হে? তেমন কিছু নয়? আর চাকরি কোথায় পেয়েছ, বললে’?
‘আজ্ঞে
বলিনি তো। এবার বলব’। ভুষি বিখ্যাত একটি কোম্পানীর নাম বলাতে, প্রাণপণবাবু
উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,
‘বাঃ।
তুমি তো সাংঘাতিক ছেলে হে? এমন গুণের ছেলে হয়েও তুমি লোকের বাজারের থলি বয়ে
বেড়াচ্ছো? তা দেবে থোবে কেমন?’
‘ছি
ছি স্যার, কেউ কিছু দেবে থোবে বলে আমি বাজারের থলি বইছি, এ আপনার ভ্রান্ত ধারণা।
আর আমিও যার তার থলি কেন বইব, স্যার? আপনার মতো লোকের থলি বওয়ার মধ্যে একটা বেশ
বড়সড় ইয়ে আছে, স্যার’।
‘আরে
রাম রাম, আমি সেকথা বলিনি। বলছিলাম যেখানে
জয়েন করছো, তারা মাইনে পত্তর কেমন দেবেথোবে
?’ খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে ভুষি বলল,
‘শুনেছি
ছেলেদের মাইনে, আর মেয়েদের বয়েস – জিগ্যেস করতে নেই! কথাটা কী সত্যি, স্যার?’
হো
হো করে হেসে উঠে প্রাণপণবাবু ভুষির কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘তোমাকে
প্রথমে চিনতে পারিনি, তবে এখন দেখছি, তুমি বেশ ইন্টারেস্টিং’।
‘আপনাকে
আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকেই চিনি স্যার। আপনার হয়তো মনে নেই, আমাদের স্কুলে আপনাকে
একবার সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেই ফাংসানে স্যার আমি একটা লেকচার দিয়েছিলাম, লিখেওছিলাম
আমিই!’
‘মনে
নেই আবার? বেশ মনে আছে। তুমিই সেই ছেলে? চিনতে পারিনি হে, অনেক বড়ো হয়ে গেছ!’
‘আজ্ঞে
আপনাদের মতো মানুষের কত শত চেনাজানা, আমাকে ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক’।
‘আরে
না না, মোটেও তা নয়। আসলে তুমি আমার সম্বন্ধে যা যা বলেছিলে সে সব কথা
ভোলা যায়? চলো বাড়ি চলে এসেছি, বাঁদিকে ঘুরেই সেকেণ্ড বাড়িটা’।
‘আপনার বাড়িও চিনি স্যার,
সবুজ রঙের দরজা, পেতলের নেম প্লেট পিপি লাহিড়ি, অ্যাডভোকেট’
‘ভেরি গুড, এত পরিশ্রম
করলে যখন, একটু বসে চা-টা খেয়ে যাও’।
‘না না স্যার, ওসবে কী
দরকার? বাড়ির লোককে ব্যতিব্যস্ত করা। না না
স্যার আজ থাক, আরেকদিন বরং...’
‘দ্যাখো হে ছোকরা। বাড়ির লোক
ব্যতিব্যস্ত হবে কিনা, সেটা আমি বুঝবো। বেশি ফাজলামি করো না, একটু বসে, চা না খেয়ে তোমার আজ পরিত্রাণ নেই, এ কথাটা
জেনে রাখো’।
‘আজ্ঞে এত করে যখন বলছেন, তখন
কী আর করা? কিন্তু পরে আমাকে কোন দোষ দেবেন না কিন্তু!’
কলিংবেল টিপে দরজার বাইরের
অপেক্ষা করতে করতে প্রাণপণবাবু বললেন,
‘দোষের কথা আসছে কোথা থেকে?’
‘না স্যার, মানে ইয়ে বলছিলাম,
আমি আসাতে বাড়ীর সবাই খুশী নাও হতে পারে তো?’
‘কেন? কেন? খুশী হবে না কেন?
বাই দ্য ওয়ে, আমার কন্যার নামও খুশী, আর ছেলের নাম আনন্দ’।
‘জানি, স্যার। খুশী আমাদের
স্কুলেই পড়তো, একই ক্লাস, কিন্তু অন্য সেকসন। খুব ভালো
মেয়ে, কিন্তু জানি না কেন আমাকে দেখলে মোটেই খুশী হয় না কোনদিন’।
‘বাবা, তুমি তো দেখছি, আমার ঠিকুজি
কুলুজি সব জেনে বসে আছো? তা খুশী তোমার ওপর অখুশী হবার কারণ কী জানতে পারি’?
‘আমিও জানি না, স্যার। জানতে
চাইওনি কোনদিন। মেয়েদের মনের খবর কে রাখে, আমিতো রাখি না, স্যার’?
দরজাটা খুলল প্রাণপণবাবুর
মেয়ে খুশীই। দরজা খুলে বাবার সঙ্গে ভুষিকে দেখে অখুশী হল, এমন তো মনে হল না। দরজা
খুলতে দেরি হলে, প্রাণপণবাবু স্ত্রীকে একটু কড়া ধমক দেন, এখন মেয়েকে বকলেন, কিন্তু
তাতে কোন ঝাঁজ নেই,
‘দরজা খুলতে এত দেরি করিস
কেন, মা? ভারি ভারি থলে নিয়ে ছেলেটা দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই থেকে’।
‘বা রে, আমি কী করে জানবো?
আমি ভেবেছি, প্রতাপদা আজ নেই, তুমি রিকশ নিয়ে আসবে! ভুষিদা যে আজকাল মুটেগিরি
করছে, জানতাম না তো?’ ভুষি ঘরে ঢুকে এসে ঘরের কোনায় থলি দুটো রাখল। প্রাণপণবাবু মেয়ের
হাতে আমিষের থলি দিতে দিতে বললেন,
‘কাকে কী বলছিস, খুশী? মানসের
মতো হীরের টুকরো ছেলে এ তল্লাটে আমি দেখিনি। তোর মা আবার কোথায় গেল? এটা রান্নাঘরে
সাবধানে রেখে আয়, তারপর মাকে ডাক’। খুশী ভেতরে যেতেই ভুষি বলল,
‘দেখলেন তো, স্যার? বলেছিলাম
না খুশী আমাকে দেখলে খুশী হবে না! আমি এখন আসি স্যার?’
‘আরে বসো, বসো, সোফায় আরাম করে
বসো। মেয়েদের সব কথায় কান দিলে চলে?’
‘কার আবার কানে কুমন্ত্রণা
দিচ্ছ?’ ভেতর থেকে প্রাণপণবাবুর স্ত্রীর গলা পাওয়া গেল, ‘সারাদিন তো লোককে
কুমন্ত্রণা দিয়ে মামলা বাগাচ্ছো? এখন ঘরেও শুরু করেছ?’ ঘরে ঢুকে দুজনকে দেখে
বললেন, ‘অ ভুষি? কখন এলে? কেমন আছো, বাবা?’ ভুষি সোফা থেকে উঠে মহিলাকে এবং তারপর
প্রাণপণবাবুকেও প্রণাম করল, তারপর বলল,
‘ভালো আছি, কাকিমা। আপনি ভালো
আছেন তো?’
‘বসো বাবা, বসো। বাবা, মা
ভালো আছেন? মিতুলের তো সামনেই ফাইন্যাল পরীক্ষা।
তোমার মতো রেজাল্ট হবে তো’?
‘সবাই ভালো আছে কাকিমা। মিতুলটা
মহা ফাঁকিবাজ, তবে মা তো দিনরাত পেছনে লেগে রয়েছে, দেখা যাক কী হয়?’
‘না, না। চিন্তা করো না। খুব
ভালো মেয়ে মিতুল, ভালোই হবে। তুমি বসো একটু চা-টা করে আনি’।
প্রাণপণবাবুর স্ত্রী
রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, প্রাণপণবাবু বললেন,
‘শুনছো। মানসের জন্যে, আজ খুব
সস্তায় প্রচুর ইলিশ পেয়েছি। চট করে কিছু
ভেজে ফেল দেখি, রোববারের সকালটা জমে যাবে একেবারে!’
‘মানসটা আবার কে?’
‘কাকিমা ওটাই আমার নাম,
মানসভূষণ’।
‘তাই নাকি? আমরা তো ভূষি বলেই
জানি!। বসো বাবা, কখানা ভেজে এনে দিই’। প্রাণপণবাবুর স্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার
পর বললেন,
‘তুমি তো সাংঘাতিক ছেলে হে?
আমি ছাড়া, আমার বাড়ির সবাই তোমায় চেনে জানে, অ্যাঁ? এ কথাটা ঘুণাক্ষরেও জানাওনি
তো? তার ওপর আবার বলছিলে তুমি এলে বাড়ির লোকেরা অখুশী হবে! আমি এ সময় মাছভাজার কথা
বললে, তোমার কাকিমা আমাকে দু কথা শুনিয়ে দিত, তুমি এসেছ বলে, এককথায় চলে গেল মাছ
ভাজতে! অবাক করলে হে?’
‘আজ্ঞে তা নয়, কাকিমাতো ভালো
মানুষ, মায়ের মতো। উনি তো খুশী হবেনই। কিন্তু খুশী আমায় দু চোখে দেখতে পারে না! কী
জানি কেন? আমার খুব ইচ্ছে হয়, আপনার সঙ্গে বসে নানান লোকের নানান গল্প শুনি।
কাকিমার সঙ্গে বসে একটু কথাবার্তা বলি। কিন্তু খুশী মোটেই অ্যালাউ করে না। বলে
আপনি নাকি খুব কড়া, গম্ভীর, আর রাশভারি মানুষ। আজে বাজে লোকের সংস্রব রাখেন না। এ
বাড়িতে যেন কখনো পা না রাখি’।
‘ছি ছি, খুশী এমন বলেছে?
কিন্তু খুশী তো আমার তেমন মেয়ে নয়। নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমি
খুশীকে ডেকে বলে দেব। আসবে না কেন? একশবার আসবে!’
‘না না এ বিষয়ে কোন কথা বললে,
খুশী খুশী মনে মেনে নাও নিতে পারে। আসলে আমার বাবা মেছো বিভূতি, মাছের আড়তদার।
ভদ্র শিক্ষিত সমাজে, তাঁকে তেমন কেউ পাত্তাটাত্তা দেয় না, একটু অবজ্ঞার চোখেই
দেখে। খুশী সেই জন্যেই আমার ওপর অখুশী’।
‘আরেঃ তুমি বিভূতিভূষণের ছেলে?
আগে বলবে তো?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ নাম ওটাই,
কিন্তু সকলে মেছো বিভূতি বলে। বিবাহ, উপনয়ন, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন কিংবা যে কোন
আনন্দ অনুষ্ঠানে আমরা সুলভ মূল্যে উৎকৃষ্ট মৎস্য সরবরাহ করিয়া থাকি। খুশীর বিয়েতে
আমার বাবার খুব ইচ্ছে আপনাদের মাছের সাপ্লাই দেওয়ার’।
‘আমাদের ক্লাবের যে কোন বড়
অনুষ্ঠানে, পিকনিকে বিভূতির থেকেই তো আমরা মাছ-টাছ কিনি, ও আর তোমায় বলতে হবে না।
তবে খুশীর এখনই বিয়ের চিন্তা তো করছি না,
মানস’।
‘না করাই উচিৎ, কী আর এমন
বয়েস ? তবে মনোমত পাত্র যদি পেয়ে যান, দেরি করেই বা লাভ কী?’
‘তা ঠিক। এম এ করে একটা
চাকরিও যখন পেয়ে গেছে, তখন অকারণ দেরি করারও কোন মানে হয় না। তা তোমার জানাশোনার
মধ্যে এমন কোন ছেলেটেলে রয়েছে নাকি?’
‘আছে বৈকি, স্যার। অনেক আছে।
খুশীর মতো মেয়েকে ঘরের লক্ষ্মী করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে, ছেলেদের বাপ-মায়েরা লাইন
লাগিয়ে দেবে! কিন্তু ভালো করে না জেনেশুনে হুট করে অচেনা অজানা ছেলের হাতে, হাত-পা
বেঁধে খুশীর মতো মেয়েকে তুলে দেওয়াটা কী উচিৎ হবে, স্যার? বিশেষ করে আপনি যেখানে
তাকে এত যত্নে আদরে, মনের মতো করে মানুষ করেছেন। খুশী কী আপনার বুকের পাঁজরের থেকে
কম কিছু, স্যার?’ আবেগে প্রাণপণবাবুর গলা গদ্গদ হয়ে উঠল,
‘তা যা বলেছো, মানস। খুশী
অখুশী হলে, আমার গোটা জীবনটাই ভূষি হয়ে যাবে’।
‘একদম ঠিক বলেছেন, স্যার।
খুশীকে জেনেশুনে ভূষির হাতে তুলে না দেওয়াটাই মঙ্গল’।
এই সময়, ভূষির পকেটের মোবাইলটা
বেজে উঠল, ফোনটা বের করে দেখল তার বাবার ফোন। ভূষি অনুমতি নিয়ে বলল,
‘এক মিনিট, একটা ফোন এসেছে, চট
করে কথাটা সেরে নিই, স্যার? হ্যালো, বলো।
ফোনের ওপ্রান্ত থেকে মেছো
বিভূতি বললেন,
‘কী রে? শুনলাম তুই হাফ দামে
মাছ বিলি করে বেড়াচ্ছিস?’
‘হাফ দাম কোথায়? আর যা দাম
নিয়েছি, তোমার লস তো হয় নি, বাবা’!
‘হতভাগা, লাভ না হওয়াটাও
একধরনের লস, সেটা জানিস? ব্যবসাটা আর কবে শিখবি?
তা এই বিশেষ ডিসকাউন্টটা কাকে দিলি, শুনি?’
‘খুশীর বাবা, প্রাণপণবাবুকে’।
‘ছি ছি ছি, আমার ছেলে হয়ে তুই
এমন চশমখোর ব্যবসা শিখেছিস? হতচ্ছাড়া ছেলে, তাহলে দাম নিলি কেন’?
‘বা রে, উনি দাম না দিয়ে জিনিষ
নেবার মানুষ? কী যে বলো তুমি? এখন রাখছি, পরে কথা বলবো’।
‘তুই কী এখন ওঁদের বাড়িতেই’?
‘হুঁ’।
‘বা বা বা, প্রানপণবাবুকে
রাজি করিয়ে, খুশীমাকে যদি এনে দিতে পারিস, বাস...’
‘ঠিকাছে ঠিকাছে, রাখছি’। ফোনটা অফ করে প্যান্টের পকেটে রাখতে,
প্রাণপণবাবু হাসি মুখে জিগ্যেস করলেন,
‘কার ফোন, বাবার? কম দাম
নিয়েছ শুনে, খুব বকাবকি করলেন নিশ্চয়ই’?
‘না, স্যার। উলটে যাচ্ছেতাই
গালাগালি করল, আপনার থেকে দাম নিয়েছি বলে?’
‘কেন? কোন খুশীতে দাম নেবে
না, শুনি?’
‘তা জানি না স্যার, তবে ওঁনার
একটাই কথা, খুশী’।
দুটো প্লেটে ইলিশমাছের চারটে
গাদা ভেজে প্রাণপণবাবুর স্ত্রী ঘরে এলেন। ভূষি বলে উঠল,
‘এঃ কাকিমা, এযে গাদা মাছ
ভেজে নিয়ে এলেন’।
‘গাদা আবার কোথায়? দুটো করে ভেজে
আনলাম, শুরু করো, আরো আনছি’।
‘আমাকে আর দেবেন না কাকিমা।
স্যারকে দিন। আপনি নিন, খুশীকে দিন। তাতেই আমাদের খুশী, তাতেই আমাদের আনন্দ’।
বিনা বাক্যব্যয়ে প্রাণপণবাবু
গরম মাছভাজার টুকরো ভেঙে মুখে নিয়ে বললেন,
‘বাঃ, যেমন টেস্ট তেমনি
সুবাস। কোলাঘাট ছাড়া এমন মাছ হয় না, মানস। খাও খাও, বসে আছো কেন? ঠাণ্ডা হয়ে যাবে
যে!’
বড়ো একটা থালায়, অনেকগুলো
মাছভাজা নিয়ে কাকিমা ঘরে এলেন। খুশী আর আনন্দও ঢুকল তাঁর পিছনে। প্রাণপণবাবুর
প্লেটে আরো দুটো মাছভাজা দিয়ে কাকিমা বললেন,
‘কই? তুমি তো এখনো শুরুই করলে
না, ভূষি?’
‘আজ্ঞে কাকিমা, আপনারা সকলে
খেয়ে যদি খুশী হন, আনন্দ পান, তার থেকে আমার আর কিসে খুশী? কিসে আনন্দ? তবে কিনা
ময়রা কোনোদিন নিজের বানানো দই, মিষ্টি খায় না। রান্নার ঠাকুর ভালো ভালো রান্না
করে, কিন্তু নিজে খায় পান্তাভাত আর পেঁয়াজ। আমাদেরও তাই, মাছে খুব একটা রুচি আসে
না।’ প্রাণপণবাবু মুখের থেকে কাঁটা বের করতে করতে বললেন,
‘কী যে বলো! ওভাবে ভাবো
কেন? তোমার বাবা মাছের ব্যবসা করেন, তাতে
কি? তোমার সঙ্গে কথা বার্তা বলে বুঝতে পারছি, মাছের ব্যবসাও বেশ ব্যবসা। খাসা
ব্যবসা’।
‘এতটাই ভরসা দিচ্ছেন যখন, মুখ
ফুটে তখন একটা কথা বলে ফেলি, স্যার?’
‘আমি ততক্ষণ চা করে আনি’।
ভূষির এই কথা শুনেই খুশী দৌড়ে ভেতরে চলে গেল চা করতে।
‘বলে ফেল, হে বলে ফেল। এখন
খুব ভালো মুডে আছি’।
‘আজ্ঞে ইয়ে বলছিলাম কী, স্যার
আপনাদের এই খুশী যদি আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে পারতাম, আমার বাবা-মাও খুব খুশী হতেন।
বাবা তো খুশীতে পাগল, বলেন খুশীর মতো একটি মেয়ে যদি আমার মেয়ে হয়ে, আমাকে বাবা
বলত, তার থেকে খুশী তিনি আর কিছুতে হবেন না’। প্রাণপণবাবু একটু অবাক হয়ে স্ত্রীর
দিকে তাকালেন, তারপর বললেন
‘তুমি কোন খুশী, কিসের খুশীর
কথা বলছো বলো তো? আমার তো সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। তুমি কী আমাদের খুশীর কথা বলছো?
সে খামোখা তোমার বাবাকে বাবা বলবে কেন? আর তাতে বিভূতিবাবুরই বা খুশী হওয়ার কী
আছে? যা খুশী বকে চলেছ!’
‘আজ্ঞে তা বটে, খুশীর খুশীর
দিকটাও তো ভাবার আছে! সে যদি খুশী হয়েই আপনার সঙ্গে আমার বাবাকেও বাবা বলে, তাতে
আপনি কী খুশী হবেন না, স্যার। খুশী যদি তাঁর, মানে ওই বিভূতিবাবুর পুত্রবধূ হয়,
তাহলে তিনি খুশীর মতো মেয়ে পেয়ে খুশীও হবেন’।
‘বিভূতিবাবুর পুত্রবধূ?’
জীবনে এত অবাক আর কখনো হননি প্রাণপণবাবু, মাছভাজা খাওয়া থামিয়ে তিনি ভূষি এবং
স্ত্রীর মুখের দিকে বার বার দেখতে লাগলেন। প্রাণপণবাবুর স্ত্রী নির্বিকার মনে
মাছভাজা খাচ্ছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন,
‘ছোঁড়া কী বলছে, শুনতে
পেয়েছো?’
‘কালা তো আর নই, শুনতে পাবো
না কেন?’
‘কিছু বলছো না যে?’
‘কী আবার বলবো? ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট, দারুণ চাকরি। দেখতে
শুনতেও খাসা। বিয়ের পরেও আমার মেয়েটা এই শহরেই চোখের সামনে থাকবে। সেই কবে থেকে
ওদের পুরো বংশটাকে চিনি। আমার খুশী মাছ খেতে ভালোবাসে, সে অভাব ওদের বাড়িতে কোনদিন
থাকবে বলে মনে হয় না। এমন ছেলে পাবে কোথায়? তোমার তো আইনের ব্যবসা, কাজ কারবার যতো
চোর জোচ্চোর আর বদমাশদের সঙ্গে। তোমার ওপর আমার ভরসা হয় না বাপু। তার থেকে ভূষিতেই
আমি খুশী’।
ভিজে বেড়ালের মতো ভূষি এখন
মাথা নিচু করে মাছের টুকরো মুখে পুরল, তার মুখে আর কথা নেই। আর এই সময় খুশী বড়ো
একটা ট্রেতে চায়ের কাপ নিয়ে প্রথম কাপটা রাখল প্রাণপণবাবুর সামনে। তারপর মাকে,
তারপর ভূষিকে। ভূষিকে চা দেওয়ার সময়, দুজনের চোখাচোখিটা প্রাণপণবাবুর চোখ এড়াল না।
তিনি আগুনের মতো রেগে উঠে বললেন,
‘এটা কন্সপিরেসি, ষড়যন্ত্র’।
‘আই পি সি ১৮৬০ সেকসন ১২০এ’
প্রাণপণবাবুর স্ত্রী বললেন।
‘তার মানে?’
‘সেকসনটা বলে দিলাম, তোমার
কেস খাড়া করতে সুবিধে হবে। জুনিয়রদের মাথায় আর কাঁঠাল ভাঙতে হবে না। আরো আছে,
ট্রেসপাসিং – সেকসন ৪৪১; আরো আছে ৪১৫, ৪১৭, ৪২০
চিটিংবাজি। তোমার মতো সরল সাধাসিধে আইনজীবিকে সস্তায় ইলিশমাছ খাইয়ে কুপ্রস্তাব
দেওয়া। আরও বলবো? তোমার প্রতাপকে গতকাল রাত থেকে ভূষি নিজের বাড়িতে আটকে রেখেছে।
না, না, কোন অত্যাচার করেনি, মারেওনি, ধরেওনি। খাচ্ছে, দাচ্ছে ঘুমোচ্ছে, দিব্বি
আছে। কিন্তু তাতেও অ্যাবডাকশনের কেস হয়। সেকসন ৩৬২’।
স্ত্রীর
কথায় প্রাণপণবাবু হতাশ হলেন খুব, গম্ভীরভাবে
মেয়েকে জিগ্যেস করলেন,
‘তোর
থেকে আমি এমনটা আশা করিনি, মা? তোরা সব্বাই মিলে আমাকে এমন বোকা বানালি’?
মাথা
নিচু করে দাঁড়িয়ে, খুশী মেঝেয় পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষতে ঘষতে নিচু গলায় বলল,
‘আমিও
আশা করিনি বাবা। আমি ভেবেছিলাম, ভূষিদাকে তুমি সামনে দাঁড়াতেই দেবে না। সেই
ভূষিদাকে তুমি কিনা নিজে ঘরে ডেকে আনলে! তাতেও হল না, তার প্রশংসায় একেবারে
পঞ্চমুখ হয়ে উঠলে! আর এদিকে আমি গো হারা হেরে গেলাম’।
‘সে
আবার কী? আমার প্রশংসার সঙ্গে তোর গো হারার কী সম্পর্ক?’
‘আমি
চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম, তোমাকে কনভিন্স করে, যদি ভূষিদা তোমার সঙ্গে আমাদের বাড়ি
আসতে পারে, তবেই আমি...’ খুশী হঠাৎ থেমে গিয়ে মাথা নিচু করেই রইল, তার চোখে এখন
জল। প্রাণপণবাবু আবার মেয়ের চোখের জল
একবারেই সহ্য করতে পারেন না, তাঁর রাগ রাগ ভাবটা থিতিয়ে গেল, স্নেহমাখা কণ্ঠে
বললেন,
‘
‘তবেই আমি...’ কী? বল মা, বল, আমার কাছে আর লুকোস না’।
‘সে
আমি তোমায় বলতে পারবো না, বাবা’। এই বলে খুশী দৌড়ে চলে গেল ঘর ছেড়ে। প্রাণপণবাবু হতভম্ব হয়ে,
বসে রইলেন কিছুক্ষণ, নিজের স্ত্রী আর ভূষির দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘কী
এমন কথা, যা মেয়ে সবাইকে বলতে পারে, কিন্তু বাবাকে বলতে পারে না?’ মুখঝামটা দিয়ে
প্রাণপণবাবুর স্ত্রী বলে উঠলেন,
‘কোন
বুদ্ধি নিয়ে তুমি অ্যাদ্দিন ওকালতি চালাচ্ছো বুঝি না, বাপু। বাপের কাছে নিজের বিয়ের কথা কোনো মেয়েকে কোনদিন
বলতে শুনেছ? উকিলদের ঘটে কী একটু সাধারণ বুদ্ধিও
থাকতে নেই?’
প্রাণপণবাবু
কিছু বললেন না, গম্ভীরভাবে কিছু চিন্তা করতে লাগলেন, ভূষির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সে
তখনো ভাজা মাছ খেয়ে চলেছে। দেখেই তাঁর পিত্তি জ্বলে গেল, বললেন,
‘অ্যাই
যে ছোকরা, ওপর ওপর তোমাকে দেখে বেশ ভালো ছেলেই ভেবেছিলাম’। ভূষি বলল,
‘আজ্ঞে
স্যার, ভেতরে ভেতরেও আমি খুব খারাপ বা ফ্যালনা নই। সে কথা কাকিমা, খুশী, এমনকি এই
আনন্দও জানে। আপনার সঙ্গে আজকেই প্রথম আলাপ কি না, তাই আপনার একটু ভ্রম হচ্ছে’।
‘ভ্রম
হচ্ছে? আমার ভ্রম হচ্ছে? হুঁহুঁ হুঁহুঁ,
তুমি একটি ভিজে বেড়াল! তোমার ভাব দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতেও জানো না!’।
‘আজ্ঞে,
মাছ আর বেড়ালে খাদ্য খাদক সম্পর্ক।’
‘আসলে
তুমি একটি গভীর জলের মাছ’
‘আজ্ঞে
হ্যাঁ। এ কথাটা আমার বাবাও বলেন, যে কোন জিনিষের গভীরে না গেলে সেটাকে সঠিক জানা
যায় না। জলে ডুব না দিলে কী আর সাঁতার শেখা যায়, স্যার?’
‘হুঁ।
আমার আদরের মেয়েটাকে তোমরা সকলে মিলে, সেই জলে ফেলে দেওয়ার মতলব করেছ?’
‘মতলব
বলছেন, স্যার? আমরা দুজনে – খুশি আর আমি – সেই কবে থেকে অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছি,
স্যার। এখন আপনার অনুমতি পেলেই, আমরা ভেসে
উঠবো’। ভূষির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রাণপণবাবু বললেন,
‘ভেসে
উঠবে? ওঠাচ্ছি তোমাকে ভেসে, দাঁড়াও! বিয়ে করে কোনো ছেলে ভেসে ওঠে না হে, বরং অতলে
তলিয়ে যায়। আমাকে দেখেও তোমার চৈতন্য হল না? তোমাকে আমি ডুবিয়েই ছাড়বো। এমন ডোবাবো
না! শুনছো, খুশীকে বলো তো অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে ভালো দেখে কিছু সন্দেশ
আনতে। আর শোনো হে ছোকরা, তোমার বাপ - মেছোবিভূতি
আজ সন্ধেয় বাড়িতে থাকবে? নাকি তিনি আবার কোথাও মাছ ধরতে যাবেন? ভাবছি আজ সন্ধেয়
তোমার কাকিমাকে নিয়ে, তোমার বাবা-মার সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করেই আসবো’।
‘আজ্ঞে
স্যার, এমন টাটকা সরেশ মাছ, নিজে থেকে ধরা দিতে আসছেন খবর পেলে, তিনি আর অন্য কোত্থাও
মাছ ধরতে যাবেন না’। তার কথা শেষ হবার আগেই খুশী একটা বড়ো প্লেটে অনেকগুলি
সন্দেশ সাজিয়ে নিয়ে ঘরে এল। প্রাণপণবাবু খুব অবাক হলেন,
‘এত
তাড়াতাড়ি কোত্থেকে সন্দেশ আনলি?’ সন্দেশের থালা হাতে খুশী যখন প্রাণপণবাবুর সামনে
দাঁড়াল, তার মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়ের খুশীমাখা লাজুক হাসিটা তাঁর চোখ এড়াল না।
তিনি একটা সন্দেশ হাতে তুলে নিতে তাঁর স্ত্রী বললেন,
‘আমি
আগেই আনিয়ে রেখেছিলাম, তোমার যে শেষমেষ সুবুদ্ধির উদয় হবে সে আমার জানাই ছিল’।
‘আচ্ছা?
তোমার সঙ্গে যে জীবন কাটাচ্ছি, তাতে দুর্বুদ্ধি হবে না তো কী হবে? আমার সুবুদ্ধি
যদি এসে থাকে, সে আমার ওই মেয়ের জন্যে, আর ওই... ওই... ওই... ভূষিটার জন্যে। ছোঁড়াটা একটু ডেঁপো টাইপ, কিন্তু বেশ ভালো’।
বলে হা হা করে হাসতে লাগলেন। প্রাণপণবাবুর স্ত্রী কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না,
তিনিও হাসতে লাগলেন।
ভূষি
খুশীর দিকে তাকিয়ে দুবার ভুরু নাচাতে, খুশী লজ্জা পেয়ে সোফায় বসল মুখ নিচু করে।
ভূষি মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপ খুলে লিখল, ‘খেপি, আমার সঙ্গে আর কোনদিন চ্যালেঞ্জ নিবি
না, কেমন?’ খুশীর পাশে রাখা মোবাইলে আওয়াজ হল ‘টুং’’।
..০০..
1 টি মন্তব্য:
ভীষণ মজার লাগল। বাড়ি ফেরার সময় খুশির নামোল্লেখে আন্দাজ করছিলাম শেষ অব্ধি কী হবে। এক্কেবারে মিষ্টিমুখে শেষ। খুব ভাল লাগল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন