"জয়ঢাক" ছোটদের ওয়েব ম্যাগে প্রকাশিত ছোটদের উপন্যাস।
১
ভোরবেলা চিত্তরঞ্জন
স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে, রুনুঝুনুদের বাড়ি এসে সরুদা যখন এসে পৌঁছোলো, তখন সাড়ে
পাঁচটা বাজে। আর সাধারণতঃ তার একটু আগেই, সদর দরজায় তালা দিয়ে, ওদের মা আর বাবা
রোজ মর্নিং ওয়াকে যান। মেয়েরা তো আর অত সকালে ওঠে না, তাই তিন বোন, টুম্পি, রুনু
আর ঝুনুকে ডিস্টার্ব না করে, মা বাবা বেরিয়ে যান রোজ। সাড়ে ছটা নাগাদ মর্নিং ওয়াক
থেকে ফিরে, মেয়েদের ডেকে তোলেন।
সরুদা রুনুঝুনুদের
মাসতুতো দাদা। হস্টেলে থাকে, লম্বা ছুটিতে কলকাতা ফেরার পথে ক’দিনের জন্যে এখানে
থেকে যায়। আজ সরুদা ভোরে এসে দরজায় তালা দেখে প্রথমে খুব হতাশ হল। স্বাভাবিক,
কানপুর থেকে সারারাত ট্রেন জার্নি করে এসে, যদি কেউ দেখে দরজায় তালা দেওয়া, কে না
হতাশ হবে? হতাশ তো হবেই, রাগও হবে। সরুদা কাঁধের ব্যাগটা বারান্দায় রেখে, এখন কী
করা যায় ভেবে, মেসোমশাইয়ের মোবাইলে ফোন করল, কিন্তু ফোনটা কেউই ধরল না। মেসোমশাইয়ের পক্ষে ফোন
ধরা সম্ভব ছিল না, কারণ মর্নিং ওয়াকে উনি ফোন নিয়ে যান না, ঘরে রেখে যান। সরুদা
যখন ডায়াল করছিল, টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ফোনে রিংও হচ্ছিল, তিনবোন ঘুমের মধ্যে সেটা
শুনতেও পেয়েছিল! কিন্তু ভোরের ঘুমের মতো আরামের আর কিছু হয় নাকি? ওই সময়েই যত আলসেমি
এসে জাঁকিয়ে বসে মাথার মধ্যে। জং ধরা লোহার দরজার মতো, চোখের ভারি ভারি পাতাগুলো ওই
সময়ে খুলতেই চায় না! অতএব কার না কার ফোন ভেবে, ওরা ওঠেওনি, ফোনও ধরেনি। ফোনের
আওয়াজে ফিকে হয়ে যাওয়া ঘুম চোখে মেজদির দিকে রুনু একবার তাকিয়েছিল। সে দেখল মেজদিও তাকে দেখছে,
কিন্তু মেজদি ঘুম জড়ানো গলায় কী একটা বলে, ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। আর সেই দেখে রুনুও পাশবালিশটাকে
আরো জোরে জড়িয়ে ধরে, ডুব দিল ঘুমের সাগরে।
দুবার ফোনে চেষ্টা করেও,
সাড়া না পেয়ে, সরুদা বেশ মুশকিলে পড়ে গেল। বাগান পেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসহায় সরুদা
এদিক সেদিক দেখছিল, আর স্টেশনেই ফিরে গিয়ে কলকাতার ট্রেন ধরবে কিনা ভাবছিল। এমন
সময়, পাশের কোয়ার্টারের বক্সি কাকিমা দেখতে পেয়ে বললেন,
‘আরে সর্বজিৎ না? কখন
এলে? কাল রাত্রে এসেছ বুঝি? আমরা জানতে পারিনি তো?’
কাঁচুমাচু মুখে সরুদা
বলল,
‘কাল নয়, কাকিমা, এই তো,
এই মাত্র এলাম। আর এসে দেখি, দরজায় তালা। মাসিমারা কেউ নেই নাকি?’
‘নেই? দরজায় তালা দেওয়া?
কই, কিছুই জানি না তো? ওহো, হতে পারে তোমার মাসিমা আর মেসোমশাই মর্নিং ওয়াকে
গেছেন, কিন্তু মেয়েরা তো থাকবে! কলিং বেল দিয়েছ’?
‘না তা দিইনি। তবে
মেসোমশাইকে ফোন করেছিলাম, রিং হয়ে গেল, ওঠালেন না!’
‘তুমি বেল দিয়ে দেখ,
মেয়েরা নিশ্চয়ই ঘরে আছে’। খানিকটা ভরসা পেয়ে, সরুদা এরপর দরজার সামনে এসে কলিংবেল
দিল।
বার তিনেক বেল দেওয়ার পর,
টুম্পি আর ঝুনুর ঘুম ভাঙল। টুম্পি ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
‘এ সময় আবার কে এল রে,
জ্বালাতে? ওফ, শান্তিতে একটু ঘুমোতেও দেবে না, উটকো লোকগুলো!’
রুনুও ঘুম ভেঙে তাকিয়ে ওদের
কথা শুনছিল। ভরপুর দিদিগিরি ফলিয়ে টুম্পি বলল,
‘যা যা দ্যাখ, কে বেল
দিচ্ছে। এখন মোটে ছটা দশ, বলে দে, বাবার আসতে আরো আধ ঘন্টা’।
শুধু বেল টিপেই সরুদার
শান্তি হয়নি, ওদের নাম ধরেও ডাকছিল। সরুদার গলা শুনে রুনু বলল,
‘আরেঃ, এতো মনে হচ্ছে,
সরুদা! এত ভোরে কোত্থেকে এলো?’ রুনুর কথাটা ঝুনুর মোটেই বিশ্বাস হল না, বলল,
‘সরুদা কী পাগল হয়েছে?
কোন খবর নেই, কিছু নেই, হুট করে চলে আসবে! এ আমাদের সেই রুকুসুকু, সরুদার গলা করে
ডাকছে। ভোর থেকেই জ্বালাতে চলে এসেছে’!
‘তোরা কী বিছানায় শুয়ে
শুয়ে গবেষণা করবি? নাকি গিয়ে একবার দেখবি?’ ওদের মেজদি চোখ বন্ধ করা অবস্থাতেই
বলল।
রুনুঝুনুকেই উঠতে হল,
অবশেষে। দরজার সামনে গিয়ে ওরা দেখল, রুকুসুকু নয়, একদম অরিজিনাল সরুদা। অবাক হয়ে ঝুনু
জিগ্যেস করল,
‘ও মা, সরুদা? এত সকালে
তুমি কোত্থেকে?’ ঝুনু বেশ মিষ্টি করেই জিগ্যেস করল, কিন্তু সরুদা খ্যাঁক করে উঠল,
বলল,
‘তিন বোনে, এত বেলা অব্দি
ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমোচ্ছিস? ডেকে ডেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না? কী ব্যাপারটা কি তোদের?
নে নে, তাড়াতাড়ি দরজাটা খোল’।
‘দরজায় তালা দেওয়া তো’? রুনু
বলল। মুখ ভেংচে সরুদা বলল,
‘সে তো দেকতেই পাচ্চি, রুন্টি,
চাবিটা দে, তালাটা খুলি’।
‘ডুপ্লিকেট চাবি তো নেই, বাবা-মা
না আসা অব্দি খোলা যাবে না’।
‘বোঝো কাণ্ড’। সরুদা
বাইরের বারান্দাতেই বসে পড়ল ধপাস করে।
ওদের কথাবার্তা শুনে টুম্পিও
উঠে এল, ওও সরুদাকে দেখে অবাক। টুম্পি আবার সরুদার খুব পিছনে লাগে। এখন সরুদার এই
নাচার অবস্থা দেখে সে বলল,
‘ইস কী করুণ অবস্থা তোমার
গো, সরুদা? এ সময় তোমার সেই গানটা মনে পড়ছে না?’ এমনিতেই সরুদা খেপে ছিল, তার ওপর টুম্পির
ওই কথায়, সরুদা বলল,
‘সারারাত ঘুম নেই, ট্রেন
জার্নি করে এসে আমি হয়রান হচ্ছি, আর তোর এখন গান মনে পড়ছে, টুম্পি? কী গান শুনি?’ টুম্পি
খুব সিরিয়াস মুখ করে বলল,
‘সেই যে গো, সেই গানটা। “খাঁচার
পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে...”। আমরা বেশ খাঁচার পাখি আর
তুমি বাইরে, ধরো বনের পাখি। বেশ মজা না?’ রেগে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিল সরুদা, বলল
না, বরং হেসে ফেলল, তারপর বলল,
‘চ্যাংড়ামো করছিস? ঠিক
আছে, করে নে। মাসিমা আসুক তারপর তোর হচ্ছে। আমি ফুলকো লুচি আর হালুয়া খাবো, আর তোর
কপালে জুটবে শুকনো রুটি আর ঝোলা গুড়’।
‘বাজে বকো না, সরুদা।
মাঝরাতে এসে আমাদের কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলে, এমনিতেই মাথা ধরিয়ে দিয়েছ, আর মাথা
খারাপ করো নাতো!’
সরুদা টুম্পির কথায় অবাক
হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, বলল,
‘সকাল সাড়ে ছটায় তোর
মাঝরাত? তাহলে তোর সকালটা কখন হয় শুনি? মেসোমশাইকে দুবার ফোন করলাম, রিং হয়ে গেল,
তুললেন না কেন?’
‘বাবা তো ফোন নিয়ে যান
না। ফোন তো ঘরে। দুবার রিং হয়েছিল বটে, ওটা তুমি করেছিলে’?
‘তোরা শুনেছিস, তাও
তুলিসনি? জানিস বক্সি কাকিমার সঙ্গে দেখা না হলে, আমি এতক্ষণ স্টেশনে ফিরে
যাচ্ছিলাম!’ টুম্পি নির্বিকার মুখে উত্তর দিল,
‘ধুর, এসময় কলকাতার কোন
ট্রেনই নেই। স্টেশনে গিয়ে বসে থাকতে। আর বাবা ফিরে এসে তোমার মিস কল দেখে, কল
ব্যাক করে, তোমাকে আবার ডেকে আনতেন’। সরু খুব রেগে উঠল,
‘তার মানে? টুম্পি
তুই...তোকে...তোর মাথা...গাঁট্টা মেরে যদি না ফুলিয়েছি, তো আমার নাম বদলে দিস’। রুনু-ঝুনু
ওদের কথাবার্তায় বেশ মজা পাচ্ছিল ঠিকই, তবে সরুদার এমন অসহায় অবস্থা দেখে ওদের খারাপও
লাগছিল। টুম্পি বলল,
‘বারে, তুমি আমার মায়ের
হাতের ফুলকো লুচি, মজা করে খাবে, আর আমাদের খাওয়াবে শুকনো রুটি? এখন বোঝো ঠ্যালা, আমাদের
বুঝি হিংসে হয় না?’ প্রচণ্ড রাগে সরুর হাত নিসপিস করছিল, কিন্তু কিছু করার নেই,
বলল,
‘তুই ...তুই একটা হিংসুটি
বুড়ি, ঝগড়ুটি আর আর...’
সরুদার কথা শেষ হল না,
পিছন থেকে রুনুঝুনুর মায়ের গলা শুনতে পাওয়া গেল,
‘ওই দ্যাখো, সরু এসে বসে
আছে। কখন এসেছিস, সরু? দেখো দেখি ছেলেটার কী হয়রানি হল?’
মেসোমশাই পকেট থেকে চাবি
বের করে, তালা খুললেন, তারপর দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে হাসতে হাসতে বললেন,
‘আয়, ঘরে আয়। খবর-টবর না
দিয়ে ভেবেছিলি আমাদের অবাক করে দিবি, নিজেই কেমন অবাক হলি, বল?’ সরুদা ব্যাগ নিয়ে
ঘরে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে বলল,
‘অবাক হইনি, হয়রান হলাম,
মেসোমশাই। আপনি সঙ্গে ফোন নিয়ে যাননি কেন?’
‘সে অনেক কথা, বোস। আগে
ব্রাশ করে নে, তারপর চা খেতে খেতে কথা হবে, টুম্পি চায়ের জল চাপা’।
ব্যাগ থেকে ব্রাশ বের
করতেই ঝুনু সরুদার ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দিল, সরুদা ব্রাশ করতে করতে বলল,
‘মাসিমা, তোমার মেয়েগুলি
একেকটি কুম্ভকর্ণের মহিলা সংস্করণ’। মাসিমা হাসতে হাসতে বললেন,
‘না রে, কুম্ভকর্ণের
ঘুমের একটা বাঁধা নিয়ম ছিল, ওদের তাও নেই। আর অসময়ে ডেকে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙানো
গিয়েছিল, কিন্তু ওদের ভাঙানো যাবে না। ওদের যদি না ডাকিস, ওরা তিন বোনে কতক্ষণ
ঘুমোবে, কে জানে?’ গ্যাস নিভিয়ে ফুটতে থাকা জলে, চা পাতা ছেড়ে টুম্পি বলল,
‘মা, বোনপোকে পেয়েই,
আমাদের সুনাম করতে শুরু করলে?’ মাসিমা উত্তর দিলেন,
‘কেন? এই তো এবারই
হাফ-ইয়ার্লি্র শেষ পরীক্ষা দিয়ে এসে, পরের দিন বেলা সাড়ে এগারোটা অব্দি ঘুমোসনি?’ সরুদা
এমন সুযোগ আর ছেড়ে দেয়? হাসতে হাসতে বলল,
‘হে হে হে, টুম্পিদেবী
সুনাম কেনো বোলছেন, বোদনাম বোলেন’। তার উত্তরে টুম্পি বলল,
‘দাঁড়াও না, তোমার
মগনলালের মতো কথা বলা আমি বের করছি’। মেসোমশাই টয়লেট থেকে বের হয়ে আসাতে এ নিয়ে আর কথা এগোলো
না। সকলেই পরিষ্কার হয়ে ঘরে এসে বসতে, টুম্পি সকলের হাতে চায়ের কাপ দিল, আর দিল
বিস্কিট। মেসোমশাই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে, এক চুমুক দিয়ে বললেন,
‘তুই এসে পড়েছিস, খুব
ভালোই হয়েছে। আমাদের এখানে বেশ কমাস ধরেই কিছু লোক বেশ ঝামেলা পাকাচ্ছে। এবেলা
রেস্ট নিয়ে নে, সন্ধেবেলা রুকু-সুকুকে নিয়ে একটা কিছু উপায় বাৎলা তো, কী করা যায়?’
‘কী ঝামেলা?’ সরুদাও চায়ে
চুমুক দিয়ে জিগ্যেস করল, আর টুম্পিকে বলল, ‘টুম্পি, দিন দিন তুই ঝগড়ুটি হচ্ছিস
বটে, তবে চা-টা বেশ বানিয়েছিস’। টুম্পি সরু চোখে সরুদাকে দেখল, বাবার সামনে কিছু
বলল না। মেসোমশাই বললেন,
‘ঝামেলা বলতে কিছু লোক,
তারা এখানকার নয়, বাইরের কোথাও থেকে হুটহাট এসে চুরিচামারি, ছিনতাই, রাহাজানি করে
পালাচ্ছে’। সরুদা বলল,
‘এ তো এখন অল্পবিস্তর সব
জায়গাতেই হচ্ছে। পুলিশে খবর দেননি’?
‘পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে
অনেকবার, তবে এখনও পর্যন্ত তারা কিছুই করে উঠতে পারেনি’।
মাসিমা চায়ে বিস্কিট
ডুবিয়ে, এক কামড় খেতে খেতে বললেন,
‘পুলিশকে দোষ দিয়ে কী হবে
বাপু? এদ্দিন এই প্রফুল্ল নগর, এমন শান্ত আর নিরিবিলি ছিল, বলতে গেলে পুলিশদের কোন
কাজই ছিল না। আমাদের থানায় দু একজন রেখে, সবাইকে অন্য থানায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। এখন
আমাদের এই সব কমপ্লেন পেয়ে, সদর থেকে বলেছে, পুলিশ বাড়াবে। পুলিশ না বাড়ালে সামলাবে
কী করে? প্রফুল্লনগরও তো আর খুব ছোট্ট শহর নয়!’ মেসোমশাই বললেন,
‘তা ঠিক। কিন্তু ঘটনা হল
আমরা আর শান্তিতে নেই। একটু রাত হলে, কিংবা ভোরে এই মর্নিং ওয়াকে যেতেও আমাদের ভয়
ভয় করে। সেইজন্যেই আমরা এখন হাতঘড়ি, মোবাইল, আংটি কিছুই সঙ্গে নিয়ে যাই না। তোর মাসিমাকেও
দেখ না, গলাতে হার পরে না, কানে দুল নেই। এই তো সেদিন, সাড়েআটটা নাগাদ ওপাড়ার
নরেনবাবুর মেয়ে কোচিং থেকে ফিরছিল, গলার সোনার হারগাছা, আর দু কানের দুল, টেনে
ছিঁড়ে নিয়েছে। বেচারা, বাচ্চা মেয়ে, ক্লাস নাইনে পড়ে, কান ছিঁড়ে একদম রক্তারক্তি
ব্যাপার’।
‘দিনে দুপুরেও বিপদের শেষ
নেই, জানিস? পরিতোষবাবু সেদিন মেয়ের বিয়ের জন্যে, দেড়লাখ নগদ টাকা তুলে, সবে
ব্যাংকের বাইরে পা রেখেছেন, একটা লোক হঠাৎ বলে উঠল, ‘কাকু আপনার কলারে শুঁয়োপোকা
যে’! পরিতোষবাবু চমকে উঠে নিজের জামার কলার দেখতে যেমনি ঘাড় ঘুরিয়েছেন, অন্য একটা
লোক তাঁর হাত থেকে টাকার ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট!’ মাসিমা বললেন, তাঁর চোখে
রীতিমতো আতঙ্ক।
‘এ তো আমাদের কলকাতাতেও
হামেশা হচ্ছে’। সরুদা বলল। মাসিমা তার উত্তরে বললেন,
‘হ্যাঁ, বড়ো বড়ো শহরে এমন
তো আকছার হয়, কাগজে পড়েছি। কিন্তু আমাদের এখানে কোনদিন দেখিনি। যাকগে, এসব কথা এখন
থাক, কী খাবি বল। ট্রেন জার্নি করে এসেছিস, চানটান করে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খানকতক
লুচি ভেজে দিই, খেয়েদেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে, তা না হলে ক্লান্তি যাবে না’।
‘আমার জন্যে গোটা দশেক
লুচি বানিও, কিন্তু টুম্পি বলছিল ওর পেট ভালো নেই, ও মুড়ি বা শুকনো রুটি খাবে’। সরুদা
টুম্পির দিকে ব্যাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল। মাসিমা একটু অবাক হলেন, টুম্পিকে বললেন,
‘সে কী রে? তোর পেট খারাপ
আমাকে বলিসনি, সরু এইমাত্র ঘরে ঢুকল আর জেনে গেল?’
‘মা, তোমার হিংসুটে
বোনপোকে তুমি চেন না’? টুম্পির এই কথায় মাসিমা এবং মেসোমশাই আসল ব্যাপারটা বুঝতে
পারলেন। তারপর সকলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন। এমন কি সরুদা, রুনু-ঝুনুও। টুম্পিই
শুধু হাসল না। গোমড়া মুখে তাকিয়ে রইল, জানালার বাইরে ঝুলে থাকা আকাশের টুকরোটার
দিকে।
২
সকাল থেকে খাওয়া আর ঘুম,
ঘুম থেকে উঠে আবার খাওয়া, তারপরে আবার ঘুম। সন্ধে আটটা নাগাদ মাসিমার তাগাদায় সরুদা
উঠতে বাধ্য হল। তাছাড়া স্কুলের পর কোচিং সেরে টুম্পি, রুনুঝুনুদেরও ততক্ষণে বাড়ি আসার
সময় হয়ে গেছিল। পাঁচটা নাগাদ ওরা স্কুল থেকে ফিরে, সামান্য বিশ্রাম নেওয়ার পর নাকে
মুখে দুটো গুঁজে কোচিং ক্লাসে যায়। ছটা থেকে আটটা কোচিংক্লাস সেরে বাড়ি ফেরে সাড়ে
আটটা নাগাদ।
‘আর ঘুমোস না, সরু। আটটা
বাজল, এবার ওঠ। রাত্রে আর ঘুমোবি না নাকি? ওঠ, মুখে চোখে জল দে, এক কাপ চা করে
দিচ্ছি, খা। মেয়েগুলোরও ফেরার সময় হয়ে গেল। ওদের সঙ্গে দুটো গল্প-গাছা কর, রাত্রে
রুটি আর ডিমের ডালনা করেছি, এত ঘুমোলে খাবি কী করে’? মাসিমার লাগাতার ডাকাডাকিতে সরুদা
উঠে পড়ল, বিছানাতেই বসে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল,
‘কতো দিন পর ঘুমোলাম
জানো, মাসিমা?’
‘কেন? ঘুমোসনি কেন? কেউ
বারণ করেছিল?’
‘সেমেস্টার চলছিল না?
সারারাত জেগে পড়তে হয়েছে। পাঁচ-ছদিন ঘুমই হয়নি। রাত সাড়েতিনটে চারটে পর্যন্ত পড়ে,
শুতে যেতাম, আর আটটা নাগাদ উঠেই দৌড়তাম পরীক্ষা দিতে’।
‘সারা বছর ফাঁকি দিলে এমন
তো হবেই! এখন যা, উঠে পড়, রাত্রে আবার ঘুমোস’।
সরুদা চা খেতে খেতে
টুম্পিরা কোচিং থেকে ফিরল। পায়ের জুতো খুলতে খুলতে টুম্পি বলল,
‘সরুদা, তুমি আবার আমাদের
বলছিলে? কী ঘুমোতেই পারো, বাপরে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমার চোখদুটো সাদাটে হয়ে গেছে!’
‘তার মানে? চোখ সাদা হয়ে
গেছে’? চমকে উঠে, আয়নায় নিজের মুখটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে এসে সরুদা বলল, ‘একটু ফোলা
ফোলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কই সাদা তো হয়নি’?
‘অনেকক্ষণ ইঁট চাপা থাকলে
ঘাসগুলো সাদাটে হয়ে যায় না? এতক্ষণ চোখের পাতার নিচে চাপা থেকে তোমার চোখদুটোও
সাদাটে হয়ে গেছে। তুমি দেখত পাচ্ছো না?’ টুম্পি মুচকি হেসে বলল।
‘অ। এয়ারকি করছিস? তোদের
স্কুলে আর কোচিংয়ে কী এই সবই শেখায়? ঝগড়া করা, পেছনে লাগা, বড় দাদাকে হেনস্থা করা?’
‘হি হি হি, ঠিকই ধরেছ,
সরুদা। আর এই সবকটা বিষয়ে আমিই টপার’। হাসতে হাসতে টুম্পিরা ভেতরে গেল, কোচিংয়ের
জামাকাপড় ছাড়তে। সরু চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এল, সিমেন্টের বেঞ্চে বসতেই তার
চোখে পড়ল, পেয়ারা গাছের নিচেয় রুকু-সুকু দাঁড়িয়ে আছে।
‘কি রে? রুকুসুকু? কতক্ষণ
এসেছিস? সব খবর ভালো?’ রুকু আর সুকু একগাল হাসল, রুকু বলল,
‘হ্যাঁ দাদা, ভালই আছি।
আপনার খবর ভালো তো? আপনি এসেছেন শুনে, আমরা অনেকক্ষণ এসে বসে আছি। আপনি
ঘুমোচ্ছিলেন, তাই অপেক্ষা করছিলাম’। তার এই ঘুম নিয়ে সরু আর কোন কথা শুনতে বা বলতে
রাজি নয়, তাই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল, বলল,
‘হ্যারে, প্রমথবাবু আর
কাত্যায়নশাস্ত্রী কেমন আছে? সব ঠিকঠাক চলছে তো’?
‘একদম ঠিকঠাক চলছে, দাদা।
প্রথমবাবুর অনেকগুলো ফ্ল্যাট, এই পুজোর পরই রেডি হয়ে যাবে। আর কমাস পরেই নিজের
নিজের ফ্ল্যাট পেয়ে যাওয়ার আনন্দে লোকজন ভালোই আছে। এখন আর কোন ঝগড়া বিবাদ নেই।
শাস্ত্রীজিও জমিয়ে জ্যোতিষ চর্চা করছেন। ওঁর চেম্বারে এখন খুব ভিড় হয়। এই
শহরের বড়ো বড়ো ব্যবসাদার সবাই, শাস্ত্রীজির
পরামর্শ ছাড়া কোন কাজই করেন না। শাস্ত্রীজির এখন খুব পসার’।
‘খুব ভালো হয়েছে, রে!
দুজনেই খুব দুঃখ কষ্টের মধ্যে পড়েছিল। এখন আবার সব সামলে গেছে’।
‘হ্যাঁ দাদা। সমাজে
আমাদেরও খুব বদনাম হয়ে গিয়েছিল, সকলে বিচ্ছিরি রকমের ছি ছি করছিল, আমরা মানুষের
ক্ষতি করেছিলাম বলে। কিন্তু এখন তারাই আবার আমাদের খুব প্রশংসা করে। বলে রুকু-সুকু
খুব শুধরে গেছে’।
‘বাঃ। ভাল হয়েছে’।
‘এ সব আপনারই পরামর্শে আর
সুবুদ্ধিতে হয়েছে, দাদা’।
‘আরে না, না। আমি তো শুধু
পরামর্শ দিয়েছিলাম, কাজটা তো তোরাই করেছিলি। ‘জয়ঢাকে’ তোদের নিয়ে অনেক লেখা
বেরিয়েছে, জানিস তো? ‘ভুতের ভরসা’ পড়ে সবাই বলছে, বেনিয়ানের থেকেও ভুতদের এখন বেশি ভরসা করা যায়’!
এই সময় মেসোমশাই অফিস
থেকে ফিরলেন। বারান্দায় ঢুকেই জিগ্যেস করলেন,
‘কি রে, একলা বসে আছিস’?
সরুদা বলল,
‘ওই তো রুকু-সুকু এসেছে,
ওদের সঙ্গে কথা বলছিলাম।’।
‘সকালে যে ব্যাপারটা
বলছিলাম, সেটা নিয়েও আলাপ করে দেখিস’।
‘আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।
আমি কথা বলে দেখছি’। মেসোমশাই ঘরে ঢুকে যেতে সরুদা জিগ্যেস করল,
‘আজকাল, এখানে,
প্রফুল্লনগরে কিছু লোক চুরি, ছিনতাই করছে, সে ব্যাপারে কিছু জানিস?’
‘জানি বৈকি, সরুদা। সব
জানি’। সুকু বলল।
‘তাই? জানিস যদি তো কিছু
করছিস না, কেন?’
‘না, দাদা, আজকাল আমরা
নিজেরা কিছুই করতে পারি না। আমাদের সমাজে এখন খুব কড়াক্কড়ি। কোন ভাবে কোন মানুষকেই
ভয় দেখানো যাবে না। ঘাড় মটকানো, ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া, এক পা মাটিতে আর অন্য পা
তালগাছের মাথায়, এসব দেখানো পুরোপুরি বন্ধ? এমন কী আগে আমরা যে নিজেদের মুণ্ডুটা
ধড় থেকে আলাদা করে নিজেদের মধ্যে ক্যাচ প্র্যাকটিস করতাম, সেও বন্ধ। ধরা পড়লে...’
সুকু কথা শেষ করতে পারল না, ভয়ে যেন শিউরে উঠল। সরুদা খুব অবাক হল, বলল,
‘কী হয় ধরা পড়লে?’
‘সে অনেক রকমের শাস্তি
আছে, যেমন যেমন অপরাধ, তেমন তেমন শাস্তি’।
‘ঠিক আছে, দু একটা নমুনা
বল না, শুনি। নাকি সে সব বলাও বারণ’।
‘না বারণ নয়, তবে সে
বেজায় ভয়ংকর। যেমন ধরুন কেউ যদি ঘাড় মটকায়। হাট্টাকাট্টা জোয়ান ভুতেরা তাকে ধরে,
সারা দিন আটা মাখার মতো চটকায় আর টুকরো টুকরো করে লেচি বানিয়ে, শিলনোড়াতে বেলতে
থাকে’।
‘কী বাজে বকছিস,
শিলনোড়াতে বাঁটে, আর চাকিবেলুনে বেলে’।
‘না দাদা, আমাদের শিলনোড়াতেই
বেলে। আমাদের এই হাওয়া মাখা ধোঁয়াটে শরীরটা শিলে যখন ছেৎরে একেবারে মাখামাখি হয়ে
যায়, তখন আবার সব জড়ো করে, মেখে ফেলে... তারপর আবার লেচি বানিয়ে...ওফ এরকম চলতেই
থাকে দিন ভর, মাস ভর’।
‘সে কী রে? তোদের এমন
কিছু হয়নি তো, কোনদিন?’
‘না, দাদা হয়নি। তবে সেই
যে সেবার প্রথমবাবু, শাস্ত্রীজি আর তাদের সব লোকজনের গায়ে মাথায় আমরা ঢিল
ছুঁড়েছিলাম, মনে আছে?’
‘আছে। কী হয়েছিল, তার
জন্যে শাস্তি হয়েছিল?’
‘হয়নি আবার? তিনদিন
আমাদের শুধু ঢিল খেয়ে থাকতে হয়েছিল। পেটটা যেন ঢিলের বস্তা হয়ে উঠেছিল! আর সেই
ভারি পেট নিয়ে, আমরা একজায়গাতেই থুপ হয়ে বসে থাকতাম। আমাদের ভুত পুলিশরা, ব্রেকফাস্ট,
লাঞ্চ, টিফিন আর ডিনারে এক ঝুড়ি করে ঢিল খাওয়াত। খেতেই হবে, না খেলে আরো ভয়ংকর
শাস্তি’।
‘বাপরে, তোদের অবস্থা বেশ
ঢিলে হয়ে গেছিল। ঠিক আছে, বুঝেছি। তোদের কিছু করতে হবে না। কিন্তু
ওই শয়তান লোকগুলো কারা, সেটা বলতে পারবি তো? কোথায় থাকে। ওরা দলে কজন, সেটা তো
বল’।
সুকু রুকুর দিকে একবার
তাকাল, তারপর সুকু বলল,
‘ওদের মধ্যে চোদ্দজন আছে।
দুজন দুজন করে সাতটা দল, আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করে। কেউ কেউ কাগজের বাস্কে
শুঁয়োপোকা বা কেন্নো...’। ঠিক এই সময়েই টুম্পি আর রুনুঝুনু বারান্দায় এল। টুম্পি
হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ওঃম্মা কোথায় কেন্নো,
কোথায় শুঁয়োপোকা, অ্যাই সুকু, কোথায় শুঁয়োপোকা দেখলি রে? আর কেন্নো? ওগুলো জানিস
তো, ঘুমোনোর সময় কানের মধ্যে ঢুকে যায়, আর মাথার মধ্যে বাসা বানায়। তারপর মাথার ঘিলু
সব খেয়ে নিয়ে মাথাটা ফোঁপরা করে দেয়’।
‘আর যাদের মাথায় ঘিলু
নেই, গোবর থাকে? তাদের কী হবে? না খেতে পেয়ে কেন্নো মরে যাবে তো?’ সরুদা বলল।
মাথায় ঘিলুর বদলে গোবর থাকার ব্যাপারটা শুনে টুম্পি একটু রেগেই গেল, বলল,
‘সরুদা, ভালো হবে না
কিন্তু, আমার মাথায় গোবর?’
‘বোঝো। আমি কী বলেছি, তোর
মাথায় গোবর? আমি শুধু জিগ্যেস করলাম, যদি মাথার মধ্যে গোবর থাকে, সেক্ষেত্রে
কেন্নোরা কী খাবে? তুই চটে উঠছিস কেন? রুকু-সুকুর সংগে আমার একটা জরুরি কথা হচ্ছে,
চুপ করে শোন। বাজে বক বক করে দিমাক খারাপ করিস না। হ্যাঁ সুকু, কী যেন বলছিলি’?
৩
সুকু আবার বলতে শুরু করল,
‘হ্যাঁ, বলছিলাম যে, কিছু কিছু লোক কাগজের বাস্কে শুঁয়োপোকা, কেন্নো
পোষে...’।
‘ইস, লোকে কুকুর, বেড়াল পোষে, পাখিপুকলি, খরগোশ পোষে, তার একটা মানে
হয়, তাই বলে শুঁয়োপোকা, কেন্নো পোষা? ইয়াক...ছিঃ’।
‘টুম্পি ওটাই ওদের পেশা, কথার মধ্যে কথা না বলে, চুপ করে শোন। তারপর?’
‘কেন্নো পোষা লোকেরা ওই
ব্যাংকে বা পোস্টাফিসের সামনে ঘুরঘুর করে। আর সরল সাদাসিধে লোক অনেক টাকা তুলছে
দেখলেই, তাদের গায়ে পোষা পোকা ছেড়ে দিয়ে চমকে দেয়। ওই সময় আনমন হলেই অন্য লোকটা
টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট দেয়। এদের দলেই কিছু লোক আছে, যারা একটা বাইকে দুজন
করে আসে। হেলমেট আর সানগ্লাস পরে চোখ মুখ অনেকটাই ঢেকে নেয়। তারপর কোন একলা মেয়ের
গায়ে গয়না দেখলেই, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাইকের স্পিড একটু কমিয়ে দেয়। তখন পিছনে বসে থাকা লোকটা
গলা থেকে সোনার হার, কিংবা কানের দুল, ছিনিয়ে নেয়’।
‘সাংঘাতিক’। সরুদা বলল।
সুকু ঘাড় নাড়ল, তারপর বলল,
‘আরও কিছু লোক আছে যারা,
আরো বিপজ্জনক। নির্জন রাস্তায় এক দুজনকে দেখলে, ছোরা-ছুরি দেখিয়ে ঘড়ি, আংটি,
মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ কেড়ে নেয়। আর বাইক নিয়ে চটপট পালিয়ে যায়। মোটামুটি এই
তিনভাবেই ওদের কাজ করতে, দেখেছি’।
‘হুম। সব মিলিয়ে, এরা
বলছিস চোদ্দজন। সবাইকে একদিনে একসঙ্গে ধরা তার মানে সম্ভবই নয়। কবে কোথায়,
কে, কখন, কী মতলবে ঘুরছে, চট করে ধরাও খুব মুশকিল। আবার দু চারজনকে যদি ধরে ফেলা
যায়, অন্য লোকেরা সেটা জেনে যাবে, সতর্ক হয়ে যাবে। আচ্ছা, এদের মধ্যে কী যোগসাজশ
আছে? নাকি এরা সবাই আলাদা আলাদা’?
‘না সরুদা, এরা সকলেই একই
দলের। শুধু আলাদা আলাদা ফিকির বেছে নিয়েছে’।
‘কোথায় থাকে, জানিস? সকলে
কী একই জায়গায় থাকে?’
‘উঁহু। সঠিক কোথায় থাকে
বলতে পারবো না। তবে এক জায়গার লোক নয়। আর এটুকু বলতে পারি, এরা কেউই প্রফুল্লনগরের
বাসিন্দা নয়। এই দলে আটজন বাঙালি আছে, আর বাকিরা বিহারি’।
‘এরা কে কোথায় থাকে, সেটা
তোরা বের করতে পারবি না?’
‘বের করা যাবে, তবে এক
দুদিন সময় দিতে হবে। খুব দূরে তো আর নিশ্চয়ই থাকে না, প্রফুল্লনগরের বাইরে, দশ-পনের
কিলোমিটারের আশেপাশেই সবাই থাকার সম্ভাবনা’।
‘কিন্তু সেটা জেনেও খুব
লাভ হবে না, পুলিশকে বললেও, আমাদের কথায় পুলিশ তো আর হুট করে ধরতে যাবে না! বলবে
জোরালো প্রমাণ দাও। তারপর বলবে, ওদিকটা অ্ন্য থানা। আর যদি আলাদা জেলা বা রাজ্য
হয়ে যায়, তাহলে তো আরো সমস্যা। এক থানার পুলিশ ইচ্ছেমতো অন্য থানার ভেতরে ঢুকে, চট
করে ধরপাকড় করতেও পারবে না’।
‘একটাই উপায়, ঘটনার সময়
হাতেনাতে ধরা’। সুকু বলল।
‘না রে, ওরা হঠাৎ হঠাৎ
হানা দেয়। কাজেই ঠিক কবে কোথায়, হানা দেবে, সেটা কী করে জানবি’? সরুদা খুব চিন্তা
করতে করতে বলল।
‘আমরা দুই, আর আমাদের
বারোজন বন্ধু, ওরা প্রফুল্লনগরে ঢুকলেই যদি পিছু নিই’?
‘ওরাও দুই জনের দল, তোরাও
দুই জনের দল, তাইতো? একজন পিছু নিবি, আরেকজন আমাদের খবর দিতে আসবি। বুদ্ধিটা মন্দ
নয়। কিন্তু ওরা চোদ্দজনই কী এই শহরে একসঙ্গে ঢুকবে? মনে হয় না’।
এতক্ষণ রুকু কোন কথা
বলেনি, শুধু ওদের কথা শুনছিল, এখন একটু কেশে নিয়ে বলল,
‘সরুদা, আপনি ঠিকই
বলেছেন, সক্কলকে একসঙ্গে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে,
সেটা বলবো’?
‘আরেঃ বলবি না, মানে?
একশোবার বলবি, বল না’।
‘এদের যে নেতা, তাকে আমরা
চিনি। তার বাড়িও চিনি। এই প্রফুল্লনগরেই থাকে। সে কিন্তু কোনদিন এই সব চুরিচামারি
করতে বেরোয় না। সে শুধু বুদ্ধি যোগায়, এই শহরের সব অন্ধিসন্ধির সন্ধান দেয়। এই সব চোরাই মাল রাতারাতি
পাচার করে ফেলে। সোনা বা রুপোর গয়না হলে, গলিয়ে ধাতু বানিয়ে ফেলে। তার বদলে ওর ওই দলের
লোকেরা যা রোজগার করে, তার অর্ধেকে সে ভাগ বসায়! আর দলের অন্যেরা বাকিটা নিজেদের
মধ্যে ভাগ করে নেয়’। সরুদা বলল,
‘হুঁ। ভারি ইন্টারেস্টিং
ব্যাপার! তা দলের এই মাথাটি কে? তাকে কাবু করতে পারলেই দলটাও ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে
বাধ্য’। সুকু বলল,
‘বিপিন পুনিয়া। দেখবেন
নামটা যেন পাঁচকান না হয়’।
এই সময় মেসোমশাই আর
মাসিমা বারান্দায় এলেন, সরুদার পাশে বসতে বসতে জিগ্যেস করলেন,
‘বিপিনবাবুর কী হয়েছে?’
উত্তরে সরুদা বলল,
‘মেসোমশাই, রুকু-সুকু
বলছে আমাদের এই প্রফুল্লনগরের চুরিচামারির পেছনে মূল লোক হচ্ছে বিপিন পুনিয়া। সে
সামনে আসে না, কিন্তু পিছন থেকে চোদ্দ জনের পুরো একটা দলকে চালাচ্ছে’।
‘বিপিনবাবু? অসম্ভব, হতেই
পারে না। কে বলেছে? আজেবাজে বললেই মেনে নেবো? ভদ্রলোককে আমি খুব ভালো ভাবে চিনি। রাজস্থানী
ভদ্রলোক, এখানে বহুদিনের বাস, আর অনেক ধরনের ব্যবসা। এমন সজ্জন ভদ্রলোক আমি খুব কম
দেখেছি। শহরের যে কোন সানাজিক অনুষ্ঠানে, পুজোয় নিজে থেকে অংশ নেন, প্রত্যেক জায়গাতেই
যথেষ্ট চাঁদা দেন। ওঁনার পয়সার অভাব? এসব চোট্টামি উনি কেন করতে যাবেন? না না,
হতেই পারে না। বিপিনবাবুর কত রকমের ব্যবসা আছে জানিস’? মেসোমশাইয়ের এই জোরালো
আপত্তিতে সুকু বলল,
‘কেউ বিশ্বাস করবে না, আর
সেই জন্যেই তো আমরা জেনেশুনেও এতদিন চুপ করে আছি, সরুদা’।
‘বিশ্বাস করার মতো কথা
বললেই বিশ্বাস করবো। একজন নিপাট ভদ্রলোকের সম্বন্ধে যা খুশি বলবি, আর মেনে নেব? এই
তো, টুম্পি তুই তো দেখেছিস, গতবারে যে একাংক নাটকের প্রতিযোগিতা হয়েছিল, প্রথম
তিনটে দলকে উনি নিজের খরচে মেডেল দিয়েছিলেন, মনে নেই? তাছাড়া চাঁদাও দিয়েছিলেন,
পাঁচহাজার টাকা’। মেসোমশাই বেশ বিরক্তই হয়েছেন বোঝা গেল। সরুদা এই সময় কিছু বলল
না। এই সময় তর্ক করলে, মেসোমশাই আরও জেদ ধরে নেবেন, অন্য আর কোন কথা শুনবেনই না।
সকলেই চুপ করে রইল। রুকু সুকুও পেয়ারা গাছের নিচেয় দাঁড়িয়ে রইল, কিছুক্ষণ পর মাসিমাকে
বলল,
‘আমরা এখন আসছি, মা।
দরকার পড়লে, একবার স্মরণ করবেন, ঠিক চলে আসবো’।
মাসিমা ওদের দিকে তাকিয়ে
ছিলেন, ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মেসোমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে
বললেন,
‘মানুষকে ওপর ওপর যা দেখা
যায়, সবটাই কী ঠিক? রোজই তো খবরের কাগজে নানান ঘটনা শুনি, পড়লে মনে হয় না, মানুষ
এমনও করতে পারে? সরু আর রুকুসুকু কী বলছে একটু শুনেই দেখো না। ওরা তো এখনই তাকে
ধরতেও যাচ্ছে না, বা পুলিশে খবরও দিতে যাচ্ছে না’।
মাসিমার একথার পরেও সকলে
চুপ করেই রইল। সরুদাও এখনই কোন কথা বলল না। সে আরেকটু সময় দিতে চায় মেসোমশাইকে। সরুদা
মাসিমাকে জিগ্যেস করল,
‘রাতে রুটি আর ডিমের
ডালনা করেছো বললে, না মাসিমা? ওফ ভাবতেই জিভে জল চলে আসছে’!
‘ডিমের ডালনাতেই জিভে জল,
কী লোভী হয়েছো, তুমি সরুদা, ইস’। টুম্পি বলল।
‘বেশি ইস ইস করিস না,
আমার সঙ্গে মাস ছয়েক হস্টেলে থাক, বুঝবি। ভাতের সঙ্গে শুধু উচ্ছে সেদ্ধ দিলেও, আমি
এখন দু হাতা ভাত বেশি খাবো’।
এই কথায় সকলেই হা হা করে
হেসে ফেলল। মাসিমা হাসতে হাসতে বললেন,
‘এত বাড়িয়ে বাড়িয়েও তুই
বলতে পারিস, সরু, বাপরে!’
‘না গো মাসিমা, একটুও
বাড়াইনি। গরমকালে আমাদের এখন প্রধান খাদ্য কী জানো? করেলা, ঘিয়া করেলা আর ভিণ্ডি।
করেলার সবজি হোক বা ভিণ্ডির, মশলা সেই একই চাট মশালা। দিনের বেলা তার সঙ্গে রাজমার
ঝোল। ডাইনিং হলে প্রথম দিকে গেলে গোটা ছয়সাতেক রাজমা পাওয়া যায়, একটু দেরি হয়ে
গেলে, গামলার ঝোলের মধ্যে গামছা পরে নামতে হয়, এক আধটা রাজমা খুঁজতে’!
আবার সবাই হেসে ফেলল,
সরুদার কথায়। রুনুঝুনু তো খিলখিল করে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে হেলেই পড়ল।
সরুদা আবার বলল,
‘আমার দুর্গতিতে হাসছিস?
তা তো হাসবিই! এই খেয়ে রোগা হতে হতে যেদিন কংকাল হয়ে ফিরে আসবো, সেদিন বুঝবি! পাঁজরের
ভেতর দিয়ে হু হু করে বয়ে যাবে বসন্তের বাতাস। তোদের সরুদা সরু হতে হতে সুতো হয়ে
যাবে দেখে নিস। তখনো তোরা এমনি করেই হাসবি? ছিঃ। তোদের থেকে সহানুভূতি চাইনি, জানি
সে তোদের নেই! কিন্তু একটু সমবেদনা তো দেখাতে পারতিস?’
টুম্পি আর রুনুঝুনুর হাসি
থামছেই না। মেসোমশাই, মাসিমাও হাসছিলেন, কিন্তু এখন হাসি থামিয়ে মাসিমা বললেন,
‘অ্যাই, তোদের এত কিসের
হাসি রে? ঠিকই তো বলেছে, সরু। হোস্টেলের খাওয়ায় বেচারা জেরবার হয়ে, দুটো দিন আমার
হাতের রান্না খেতে আসে। দুটো ভালো মন্দ রান্না করলেই তোরা অমনি ওর পেছনে লাগিস।
তোদের জন্যে তিনশপঁয়ষট্টি দিন, দুবেলা রান্না করেও তো তোদের মন পাই না। একটা না
একটা খুঁত ধরার জন্যে বসে থাকিস। সরুতো অমন বলে না, আদর করে যা রেঁধে দিই, সোনামুখ
করে চেঁটেপুটে খায়। যা না, বাইরে থেকে দুদিন ঘুরে আয়, টেরটি পাবি, কত ধানে কত
চাল?’
মাসিমা বেশ গম্ভীর হয়ে
কথাগুলো বললেন, তাঁর কথায় সকলেই চুপ করে রইল। সরুদা টুম্পির দিকে আড়চোখে তাকালো,
দেখল টুম্পি কটমট চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে থাকার পর
সরুদা বলল,
‘মাসিমা, খেয়ে নিলেই হয়
তো। আমার খিদেও পাচ্ছে, ঘুমও পাচ্ছে’। টুম্পি এবার চেঁচিয়ে উঠল,
‘সরুদা, সারা দিন ঘুমিয়েও
তোমার আবার ঘুম পাচ্ছে?’
‘কেন? ঘুমের ওপর ট্যাক্স
বসাবি নাকি? আমার ঘুম পাচ্ছে তো, তোর কী?’ মাসিমা উঠে পড়লেন, বললেন,
‘সেই ভালো। খেয়ে দেয়ে
শুয়ে পড়ুক সবাই। কাল সকালে আবার উঠতে হবে। ঘরে আয় সবাই, খাবার বাড়ছি’।
৪
মেসোমশাই আর সরুদার
তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে গেল। আঁচিয়ে এসে দুজনেই আবার বারান্দায় বসল। গরমের দিনে খাওয়া
দাওয়ার পর বারান্দায় বসতে বেশ ভালোই লাগে, হাল্কা হাল্কা হাওয়া বয়, তাতে আরাম
লাগে। মেসোমশাই হাসতে হাসতে বললেন,
‘তোর কথায়, তোর মাসির মনে
খুব নাড়া লেগেছে। ভালই শিখেছিস, মা মাসিদের মন জয় করতে’।
‘না মেসোমশাই, নিছক মন জয়
করার জন্যে কথাগুলো আমি বলিনি। একদম মন থেকেই বলেছি। ছোটবেলা থেকে মায়েদের যত্ন আর
আদর, আলো-বাতাসের মতো পাই বলে, আমরা তার কদর বুঝি না। এটা বুঝেছি হস্টেলে গিয়ে।
হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু এখন প্রতিটি দিন টের পাই, এর মূল্য। হস্টেলে না
থাকলে, আমিও বুঝতে পারতাম না’। সরুদা খুব আবেগ নিয়েই আবার বলল, ‘আমরা দুই ভাই, বোন
নেই তো! এবাড়িতে এলে, অনেক কিছু পেয়ে যাই। আপনার ভালোবাসা, মাসিমার কথা তো ছেড়েই
দিচ্ছি, তার ওপর, চার বোন - টুম্পি, রুন্টিঝুন্টি – বিয়ে হওয়ার আগে পুঁটলি ছিল, ভীষণ
ভালো লাগে। এখানে কদিন কাটিয়ে, মনের মধ্যে বেশ একটা চাঙ্গা তাজা ভাব হয়, সেটা নিয়ে
হস্টেলে থাকার একঘেয়েমিটাও বেশ ফিকে লাগে’।
মেসোমশাই সরুদার কাঁধে
হাত রাখলেন, বললেন,
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর
বেশি বলিস না। হতচ্ছাড়া, কাঁদিয়ে দিবি নাকি?’ সরুদা হেসে ফেলল। সরুদার কাঁধে হাত
রেখে মেসোমশাই বললেন,
‘তখন বিপিনবাবু নিয়ে আমি
একটু বেশিই বলে ফেলেছি মনে হচ্ছে। রুকুসুকু ওঁর সম্পর্কে কী বলল, বল তো?’
রুকু-সুকু যা যা বলেছিল, সরুদা মেসোমশাইকে শুরু থেকে সবই বলল। শুনে মেসোমশাই
বললেন,
‘হুঁ। আজকাল লোকজনকে ওপর
ওপর দেখে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু অবিশ্বাস করতেও খুব খারাপ লাগে’।
‘খুব স্বাভাবিক,
মেসোমশাই। তাতে আমাদের নিজেদের বিশ্বাসেই কেমন যেন একটু চিড় ধরে যায়। তাছাড়া আপনিও
জানেন, রুকু-সুকু এমন অনেক কিছু দেখতে পায়, শুনতে পায়, আমরা যা ভাবতেও পারি না। আর
ওদের যেদিন থেকে চিনেছি, মিথ্যে কথা কিংবা বাজে কথা বলতেও কোনদিন শুনিনি’।
‘সেই জন্যেই তো! আমিও পরে
বুঝতে পারলাম, ওভাবে আমার রেগে ওঠাটা উচিৎ হয়নি। ওরা একটু অভিমান করেছে মনে হয়,
না?’ মেসোমশাইয়ের এই কথায় পেয়ারা গাছের নিচে থেকে, গলা পাওয়া গেল,
‘আমরা আবার এসে গেছি,
মেসোমশাই। কিচ্ছু ভাববেন না, হে হে হে’। ওদের হাসিতে মেসোমশাই স্বস্তি পেলেন মনে
হল, নিজেই জিগ্যেস করলেন,
‘তখন ওঁনার সম্বন্ধে কী
যেন বলছিলি, রুকু-সুকু?’
‘আজ্ঞে। লোকটা দেখতে
ভদ্রলোক, কিন্তু আসলে ভয়ংকর শয়তান। এই যে এত এত চাঁদা দেয়, দানধ্যান করে, মেডেল
উপহার দেয়, এ সবই করে নাম কামানোর জন্যে। এইসব করে, পাড়াপ্রতিবেশীদের মনে এমন একটা
ধারণা তৈরি করে দেয়, যে উনি খুব সজ্জন আর দিলদরিয়া। ছোটখাটো বদনামের কথা কারো কানে
গেলেও, কেউ বিশ্বাসই করবে না। ঠিক আপনার মতো, সকলেই মনে করবে, ওঁনার মতো লোক এমন
কুকীর্তি করেছে? হতেই পারে না। হিংসুটে লোক ওঁনার মিথ্যে বদনাম রটাচ্ছে’! মেসোমশাই
বললেন,
‘হুঁ’। সরুদা রুকুকে
জিগ্যেস করল,
‘তুই তখন কী যেন বুদ্ধি
ভেবেছিস বললি, এবার বল’। রুকু নাকটা একটু চুলকে বলল,
‘ওই বিপিনের সঙ্গে আমাদের
শাস্ত্রীজির খুব চেনাশোনা। বাড়িতে যাগ-যজ্ঞ, পুজোআচ্চা, যাই হোক, শাস্ত্রীজি ছাড়া ওর চলে না। উপরন্তু শাস্ত্রীজির
বিধান দেওয়া গোটা দশেক পাথরের আংটি ধারণ করে, ওঁনার ব্যবসায় যে প্রচুর উন্নতি
হয়েছে, এ বিশ্বাসও ওঁর আছে।’ সরুদা বলল,
‘কার ব্যবসার উন্নতি
হয়েছে, রুকু? শাস্ত্রীজির নাকি বিপিনবাবুর?’ রুকু-সুকু হাসল,
‘হে হে হে সরুদা, মোক্ষম
বলেছেন, ব্যবসা বৈকি! উন্নতি দুজনেরই, নিজের নিজের ব্যবসার’।
‘সে যাক, তোর কী মনে হয়?
কাত্যায়ন শাস্ত্রীও, বিপিনের সঙ্গে, এই ব্যাপারে জড়িত?’
‘না না, সরুদা। আমাদের
শাস্ত্রীজি ওসব ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও জানে না। শাস্ত্রীজি এমনিতে লোক ভালো।
জ্যোতিষের ব্যবসা হলেও, মানুষটা ভেতর থেকে খারাপ নয়। আর আমাদের দুভাইকে এখনও খুব
খাতির যত্ন করে। প্রায়ই জিলিপিটা, কচুরিটা খাওয়ায়। শাস্ত্রীজি চেম্বারে একলা
থাকলে, মাঝে মাঝে আমরা যাই, অনেক সুখ দুঃখের কথা কয়। আমি বলছিলাম, এই শাস্ত্রীজির
মাধ্যমে আমরা বিপিনবাবুর কাছে, সহজেই পৌঁছে যেতে পারবো। আর জব্দ করার কোন উপায় যদি
আপনি বাতলে দিতে পারেন, তাহলে তো হয়েই গেল! বিপিনবাবুর জারিজুরি শেষ হয়ে যাবে’।
‘বাঃ বেশ বেড়ে আইডিয়া, আর
একদম মোক্ষম সন্ধান দিয়েছিস! এখন এটাকেই কাজে লাগাতে হবে’।
সরুদাকে গভীর চিন্তা করতে
দেখে, মেসোমশাই মস্ত এক হাই তুলে বললেন,
‘সরু আমি উঠছি রে, তুই
দেখ কী করতে পারিস। আমি গিয়ে শুয়ে পড়ি, কাল আবার অফিস যেতে হবে’। সরুদা ব্যস্ত হয়ে
বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি শুয়ে
পড়ুন মেসোমশাই, আপনি চিন্তা করবেন না’। মেসোমশাই ঘরে যেতে সরুদা, পেয়ারা গাছের
নিচে বারান্দার কোনায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসল। রুকু-সুকু আর সরুদা এখন খুব কাছাকাছি,
ওরা দুজনাই সরুদার হাতের নাগালের মধ্যে, কিন্তু ধরা যাবে না। হাওয়ার কাঁধে কে কবে
হাত রাখতে পেরেছে!
খুব নিচু গলায় ওরা কথা
বলছিল, অনেকক্ষণ। কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। টুম্পি, রুনুঝুনু রান্নাঘরে মায়ের কাজে
সাহায্য করে এসে, বারান্দায় এসে যখন দাঁড়াল সরুদা লক্ষ্যই করল না, এতটাই মগ্ন ছিল
কথাবার্তায়। তিনবোন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, বড়ো বড়ো হাই তুলে ঘরে শুতে
গেল। ঘরে ঢোকার আগে টুম্পি শুনতে পেল, ‘...বাপরে এ তো কুমীর...’, কথাটা সরুদাই
বলল। ঘাড় ঘুরিয়ে ভুরু কুঁচকে সরুদার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েও বুঝতে পারল না, কথাটা
তাকেই বলল কি না? নিজের বিছানায় শুতে শুতে পাশের বিছানায় বসা রুনুঝুনুকে টুম্পি
জিগ্যেস করল,
‘কুমীরও বড়ো বড়ো হাঁ করে,
হাই তোলে না?’ টুম্পির আচমকা এই প্রশ্নে ঝুনু বলল,
‘কুমীর হাই তুলতে যাবে
কোন দুঃখে? ওদের স্কুল নেই, কোচিং নেই, ঘরে এসে পড়া মুখস্থও নেই। খাও দাও, আর
রোদ্দুরে ঘুমোও। হাই ওঠার আগেই তো বালির চড়ায় ঘুমিয়ে পড়ে দেখিসনি? কেন বলতো,
দিদি?’
গোমড়া মুখ করে শুয়ে পড়তে
পড়তে টুম্পি বলল,
‘না এমনিই, হঠাৎ মনে এল
কথাটা’।
আরো কিছুক্ষণ পরে, মাসিমা
হাতের সব কাজ সেরে বারান্দায় এলেন। দেখলেন সরুদা পেয়ারা গাছের কাছে গিয়ে বসে আছে,
আর সঙ্গে ওই ভুত ছোঁড়া দুটোও। দেখেই তাঁর বুকটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল। এমনি
রুকুসুকু ছেলে হিসেবে খারাপ নয়, তবু অশরীরি ভুত তো! পরের ছেলে, দু দিনের জন্যে
মাসির বাড়ি বেড়াতে এসেছে, কিছু একটা অকল্যাণ হয়ে গেলে দিদির কাছে মুখ দেখাতে
পারবেন না। তার ওপর আজ আবার ঘোর কৃষ্ণা দ্বাদশী তিথি! মাসিমা বললেন,
‘কি রে, সরু। তখনই বললি
তাড়াতাড়ি খেতে দিয়ে দাও ঘুম পাচ্ছে, আর এখনো বকে চলেছিস? ঘুমোতে যাবি না?’ সরুদা
ঘাড় ফিরিয়ে মাসিমাকে দেখল, বলল,
‘তুমি শুয়ে পড়ো মাসিমা,
আমি এক্খুনি আসছি’। সারাদিনের খাটনিতে মাসিমার চোখ ঝামড়ে ঘুম আসছিল, মস্তো একটা
হাই তুলে বললেন,
‘আমি শুতে চললাম, বাপু।
তুইও বেশি রাত করিস না। শোবার সময়, বাইরের দরজাটায়, মনে করে খিল তুলে দিস’।
‘ঠিক আছে, তুমি ভেবো না।
আমি আসছি’।
৫
শ্রী কার্তিক চন্দ্র হাতি
থেকে শ্রীশ্রী কাত্যায়ন শাস্ত্রী হওয়ার পেছনে অনেক ইতিহাস আছে। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা আছে,
উত্থান আছে, পতন আছে। কিন্তু সে সব পার হয়ে এসে, আজকে তিনি যে জায়গায় এসে
পৌঁছেছেন, কাত্যায়ন শাস্ত্রী খুশী বললেও কম বলা হয়। নাম, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি,
বড়ো বড়ো মানুষদের সঙ্গে ওঠাবসা, এর থেকে বেশি আর কীই বা চাইতে পারে মানুষ!
সকালে চেম্বার খুলেই
ঠাকুর দেবতাদের মূর্তির পায়ে প্রদীপ আর ধুপ জ্বেলে অনেকক্ষণ পুজো করা তাঁর নিত্য
অভ্যাস। তারপর ছোট্ট ধুনুচিতে কাঠকয়লার আগুনে, সুগন্ধী ধুনো দিয়ে নিজের চেম্বার আর
বাইরের বসার ঘরের কোনায় কোনায় ধুনোর ধোঁয়া না দেখালে তাঁর মনে শান্তি হয় না। তিনি
যে টেবিলটাতে বসেন, তাঁর বিভিন্ন ড্রয়ারের মধ্যে কিছুটা ধুনোর ধোঁয়াও প্যাক করে
তোলেন। তারপর ধুনুচিটা ঠাকুরের শেলফের সামনে রেখে ভক্তিভরে প্রণাম করে নিজের
চেয়ারে এসে বসেন। আজও তাই বসলেন।
সামনের চায়ের দোকানের
হারু এই সময়টা মোক্ষম জেনে গিয়েছে। কাত্যায়ন শাস্ত্রী চেয়ারে বসলেই, সে আলতো চাপে
দরজাটা খুলে, গরম চায়ের কেটলি আর মাটির ভাঁড় নিয়ে আসে। কাজের শুরুতে হারুর হাতের
এই চা-টা না হলে, কাত্যায়ন শাস্ত্রির মুড আসে না। আজও ভাঁড়ে চা ঢালতে ঢালতে বলল,
‘কাতুদা, বসার ঘরে খদ্দের
বসে আছে, ওঁনাদেরও চা দেব কী?’ কাত্যায়ন শাস্ত্রী একটু অবাক হলেন,
‘কখন এসেছে? এই মাত্র আমি
ধুনো দিয়ে এলাম, তখন তো কেউ ছিল না!’ হারু চোখ মটকে বলল,
‘এসেছে গো, এক ভদ্রলোক,
সঙ্গে স্ত্রী। মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম, খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে’।
কাত্যায়ন শাস্ত্রী হেসে
ফেললেন। তাঁর সঙ্গে থেকে থেকে, এই হারুটাও দিন দিন অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। তিনি
বললেন,
‘নিশ্চয়ই দিবি। খদ্দের
মানেই লক্ষ্মী, আর প্রথম লক্ষ্মীকে চা দিবি না? একশ বার দিবি। আর বলবি, চা খাওয়া
হয়ে গেলেই যেন, ভেতরে চলে আসেন’। হারু কিছু বলল না, হেসে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে।
দরজাটা বন্ধ হবার পর, চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাত্যায়ন শাস্ত্রী ভাবলেন, যেমন চলছে,
এমন যদি চলতে থাকে, তাঁর একজন অ্যাসিষ্ট্যান্ট থাকা দরকার! একদিকে কাজের চাপটা
একটু হাল্কা হবে, আর অন্য দিকে খদ্দেরদের কাছে তাঁর সম্মান, যাকে স্টেটাস বলে,
সেটাও বাড়বে! ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। পায়ের কাছে ওয়েস্ট বাস্কেটের
মধ্যে খালি ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে, কাত্যায়ন শাস্ত্রী ড্রয়ার থেকে ছাপানো প্যাড একটা,
তার সঙ্গে লাল, সবুজ আর নীল কালির তিনটে কলম বের করলেন। আর সেই সময়েই চেম্বারের দরজাটা
একটু ফাঁক হয়ে এক ভদ্রলোকের মুখ দেখা গেল।
‘মহারাজজি আসতে পারি?’
এখানকার সাধারণ মানুষ তাঁকে মহারাজজিই বলে, লোকের মুখে মুখে এটাই চাউর হয়ে গেছে।
এই সম্বোধনে কাত্যায়ন শাস্ত্রীর আপত্তির কোন কারণই নেই, বরং এ ডাকটার মধ্যে বেশ
একটা ভারভারিক্কি ব্যাপার আছে, সেটা তিনি উপভোগই করেন। গম্ভীরভাবে তিনি বললেন,
‘আয়, আয়। মায়ের কাছে আসতে
আবার অনুমতি নিতে হয় নাকি’? ভদ্রলোক খুব সংকোচের সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন, তাঁর পিছনে
ঢুকলেন তাঁর স্ত্রী, তাঁকে দেখে মনে হল, তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন।
‘মায়ের ওপর বিশ্বাস আছে?’
বেশ বড়ো গলায় কাত্যায়ন শাস্ত্রী হেঁকে উঠলেন। ওঁর আওয়াজে দুজনেই একটু চমকে উঠলেন,
থতমত খেয়ে বললেন,
‘আজ্ঞে, আছে বৈ কি! তা না
হলে, বিপদে পড়লেই আপনার কাছে বার বার দৌড়ে আসি’। ইশারায় দুজনকে সামনের চেয়ারে বসতে
বলে, বললেন,
‘আমার কাছে, নয় রে, বল
মায়ের কাছে। যা করার তিনিই করান’।
‘আজ্ঞে সে কথা তো
একশবার’।
এই ভদ্রলোক আর
ভদ্রমহিলাকে কাত্যায়ন শাস্ত্রীর খুব চেনা চেনা লাগছিল, তাঁর পুরোন খদ্দের কোন
সন্দেহ নেই! তবে ঠিক কোন সমস্যার সমাধানের জন্যে, এঁনারা তাঁর কাছে এসেছিলেন, সেটা
মনে করতে পারছিলেন না। কাত্যায়ন শাস্ত্রী ওঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে, মনে করার
আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার আগেই ভদ্রমহিলা বললেন,
‘আপনি তো সবই জানেন,
বাবা। আপনাকে আর কী বলবো?’ এই ভয়টাই তিনি পাচ্ছিলেন, সকলেই ধরে নেন, তিনি
ত্রিকালজ্ঞ, তিনি সব জানেন। অথচ পুরোনো খদ্দেরদের কয়েকমাস,
কিংবা দু এক বছরের কথাও তিনি মনে রাখতে পারেন না। আর এর জন্যে প্রায়ই বড়ো
অস্বস্তিতে পড়তে হয়। তবু আন্দাজে তিনি একটা ঢিল ছুঁড়লেন, বললেন,
‘বেশ তো ছিলি? আবার কী
এমন ঘটল, যে মায়ের কাছে দৌড়ে আসতে হল?’ এবার ভদ্রলোক বললেন,
‘আজ্ঞে, আপনার আর মায়ের
আশীর্বাদে ভালই ছিলাম। কিন্তু গত শুক্রবার এমন একটা অঘটন ঘটে গেল, সে আর বলার নয়’। কাত্যায়ন শাস্ত্রী কিছু
বললেন না, মুখের দিকে শুধু তাকিয়ে রইলেন। ভদ্রলোক আবার বললেন,
‘আমরা দুজন খুব সকাল সকাল
মর্নিং ওয়াকে যাই। শুক্রবারেও গিয়েছিলাম। সেদিন কেন জানি না, অন্যদিনের তুলনায়
রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা ফাঁকাই ছিল। হাইস্কুলের মাঠের ধার দিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে
কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম। আশেপাশে তেমন লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়া
গাছের আড়াল থেকে দুটো ছোকরা বেরিয়ে এল, তাদের মাথায় বাইক চালানোর হেলমেট, চোখে
সানগ্লাস। তারা একেবারে আমাদের গায়ের ওপর হামলে পড়ল, আর বলল, “কাকিমা, সঙ্গে যা
আছে চুপিচুপি দিয়ে দিন, নাহলে খুব বিপদ”। দুজনের হাতেই দেখলাম, চকচক করছে
ছুরি। আমি তাও একটু তর্ক করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার স্ত্রী আমার হাত চেপে থামিয়ে
দিল, তারপর নিজের গলার হার, কানের দুলজোড়া ওদের দিয়ে দিল। আর আমাকেও বলল, ঘড়ি-টড়ি
যা আছে দিয়ে দেওয়ার জন্যে। আমি আর কী করি? হাতের ঘড়িটা আর মানিব্যাগটা দিয়েই
দিলাম। মানিব্যাগে সাড়ে তিনশ মতো টাকা আর কিছু খুচরো ছিল’।
এবারও কাত্যায়নশাস্ত্রী
কিছু বললেন না, ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে ভদ্রলোকের কথা শুনতে লাগলেন।
‘আমরা ভাবলাম মিটে গেল।
ওদের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে গেলাম, এক ছোকরা খেঁকিয়ে উঠল “ও কাকু? হাতের
আংটিগুলো দিলেন না? খুলে দেবেন, নাকি কেটে নেব?” এবার আর আমার স্ত্রী চুপ করে
থাকতে পারল না, বলল, “এগুলো তো বাবা, গয়না নয়। এর আর ক’পয়সা দাম! বিপদের থেকে
বাঁচার জন্যে এই আংটি ধারণ করেছি। এগুলো নিলে তোমাদের খুব লাভ হবে না, বাবা,
কিন্তু আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে!”
এবার কাত্যায়নশাস্ত্রী
খুব উত্তেজিত হয়ে টেবিলে ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে বসলেন, ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তারপর’? এবার ভদ্রমহিলা
কান্নাধরা গলায় বললেন,
‘কিছুতেই শুনলে না, ছুরি
নিয়ে ওঁনার হাতের আঙুল কাটতে যায় আর কি? বাধ্য হয়ে ওঁর আঙুলের দুটো আর আমার আঙুলের তিনটে আংটি খুলে দিয়ে, তবে
মুক্তি পেলাম। গাছের আড়ালে রাখা বাইকে উঠতে উঠতে কী বলল, জানেন বাবা? হ্যা হ্যা
করে হাসতে হাসতে বলল, “কাত্যায়ন মহারাজকে গিয়ে বললেই এমন আংটি আবার পেয়ে যাবেন,
কাকিমা, কিচ্ছু ক্ষতি হবে না”। রাগে আর উত্তেজনায়
কাত্যায়নশাস্ত্রী কাঁপছিলেন, তিনি ভীষণ গম্ভীরগলায় বললেন,
‘ঘটনাটা শুক্রবার সকালের
বললি, না? কী কী রত্ন ছিল মনে আছে?’
‘মনে আছে বৈকি, বাবা!
আমার হাতে ছিল রক্তপলা, গোমেদ আর পান্না। আর ওঁনার হাতে ছিল শ্বেতপলা আর চুনি’।
ভদ্রমহিলা বললেন। আর ভদ্রলোক শার্টের পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ মেলে ধরে,
কাত্যায়নশাস্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘মহারাজজি, এই আপনার সেই
বিধানপত্র। এতেই সব লেখা আছে’। কাত্যায়নশাস্ত্রী কাগজটা হাতে
নিয়ে দেখলেন, কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন,
‘এটা আমার কাছেই থাক। আমাকে
দুটোদিন সময় দিবি, মা? আমার মায়ের সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া করতে হবে। আশা করি, মা
আমাকে হতাশ করবেন না। দুটোদিন একটু ধৈর্য ধর, আমি বলছি কিছু একটা বিহিত তারামা করবেনই’!
‘আপনার ভরসাতেই দৌড়ে এলাম
বাবা। থানা-পুলিশ করে তো লাভ নেই, উলটে ওরা জিগ্যেস করবে, অত ভোরে কেন মর্নিং
ওয়াকে গিয়েছিলেন? একটু বেলা করে মর্নিং ওয়াকে যেতে পারেন। আর গেলেও দল বেঁধে
অনেকের সঙ্গে যান না কেন? গায়ে এসব দামি দামি জিনিষ নিয়ে চলা ফেরা না করলেই ভালো
হয়। বাড়িতে রেখে যান না কেন? কাজের কাজ কিছুই করবে না, মাঝের থেকে মাথা খারাপ করে
দেবে।’
কাত্যায়নশাস্ত্রী অধৈর্য
হয়ে উঠছিলেন, তিনি ওঁদের বললেন,
‘তোরা এখন আয়, আমাকে একটু
ভাবতে দে, তারামায়ের সঙ্গে আলাপ করতে দে’।
কাত্যায়নশাস্ত্রীর এই
কথায়, ওঁরা উঠে পড়লেন, ভদ্রমহিলা কাত্যায়নশাস্ত্রীকে নমস্কার করে দরজার দিকে
এগোলেন, আর ভদ্রলোক পকেট থেকে কয়েকটা নোট বের করে, ইতস্ততঃ করতে করতে বললেন,
‘মহারাজজি, ইয়ে, মানে
আপনার দক্ষিণাটা?’ কাত্যায়নশাস্ত্রী হাত নেড়ে নিষেধ করলেন, বললেন,
‘না রে। মায়ের আদেশ না
পাওয়া পর্যন্ত আমি দক্ষিণা নিতে পারবো না। মায়ের দাস হয়ে তোদের যদি বিপদ থেকে
রক্ষা করতেই না পারি, তাহলে আর কোনমুখে দক্ষিণা নেব?’ ভদ্রলোক খুব কৃতজ্ঞ মুখে
নমস্কার করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।
ওঁরা বেরিয়ে যাওয়ার পর
কাত্যায়নশাস্ত্রী নিজের টেবিলের বাঁদিকের মাঝের ড্রয়ারটা খুললেন, একটা কাগজের মোড়ক
ছিল। সেটা খুলে দেখলেন, পাঁচটি রত্ন - যেমনটি ভদ্রমহিলা বললেন, একদম সেরকমই।
টেবিলের ওপরে রাখা নিজের বিধানপত্রটি দেখতে দেখতে তিনি মোবাইলে একটা নম্বর ডায়াল
করলেন। মতিলালের নম্বর। রিং হচ্ছে, কানে ফোন নিয়ে ডায়ালটোন শুনতে শুনতে, কাগজের
মোড়কটা ভাঁজ করে, আবার ড্রয়ারটা বন্ধ করলেন।
৬
কাত্যায়নশাস্ত্রী
গ্রহশান্তির জন্যে নানান ওজনের নানান রত্নের বিধান লিখে দেন। আর এই মতিলাল সেই
বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওজনের রত্ন দিয়ে, সোনা বা রুপোর আংটি কিংবা ওপরের হাতে
পরার চেন বাঁধিয়ে দেয়। তারামায়ের সেবার জন্যে কাত্যায়নশাস্ত্রী কিছু দক্ষিণা যেমন
নেন, তেমন মতিলালের থেকে বাঁধা একটা কমিশনও পেয়ে যান এই রত্নের বিক্রি থেকে।
মতিলালের সঙ্গে তাঁর অটুট জোড়, গাঢ় সখ্যতা।
মতিলালকে ফোন করে ডাকা মাত্র
পাঁচমিনিটের মধ্যেই এসে হাজির হল কাত্যায়নশাস্ত্রীর চেম্বারে। মতিলাল চেম্বারে
ঢুকে কোন খদ্দের না দেখে একটু অবাক হল। কাত্যায়নশাস্ত্রী সাধারণতঃ মতিলালকে ডাকেন,
কোন গ্রহরত্নের অর্ডার দেওয়ার সময়, পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে। এখন তো কেউ নেই,
অসময়ে ডাকলেন কেন? মতিলাল জিগ্যেস করল,
‘কী ব্যাপার মহারাজজি?
সকাল সকাল তলব?’ কাত্যায়নশাস্ত্রী গম্ভীরমুখে বললেন,
‘চা খাবি? হারুকে দুটো চা
দেওয়ার কথা বলে আয়’। মতিলালা বাইরের ঘর থেকে চায়ের জন্যে হাঁক দিতেই হারু দু ভাঁড়
চা দিয়ে গেল। চাটা নিয়ে কাত্যায়নশাস্ত্রী বললেন,
‘এই হারু, একটু নজর রাখিস
তো। আমার ঘরে এখন হুট করে, কেউ যেন না ঢোকে। বলবি, জরুরি কথা চলছে, দেরি হবে’।
হারু ঘাড় নেড়ে দরজা বন্ধ করে চলে যেতে, কাত্যায়নশাস্ত্রী সরসরি মতিলালকে বললেন,
‘প্রফুল্লনগরে চুরি
ছিনতাই হচ্ছে শুনছিলাম, এ ব্যাপারে তুই কিছু জানিস নাকি?’
‘শুনেছি বৈকি। কিন্তু
আপনি ঠিক কী জানতে চাইছেন বলুন তো?’ চায়ে চুমুক দিয়ে মতিলাল বলল।
‘এর পেছনে কে বা কারা
আছে? আমাদের প্রফুল্লনগরেরই লোক কি না, এসব কিছু জানিস বা কিছু শুনেছিস?’
‘শুনেছি অনেক কিছু, নানান
লোকে নানান কথা বলছে। সে সবের কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যে তা বলতে পারবো না’।
কাত্যায়নশাস্ত্রী বাঁদিকের ড্রয়ার থেকে কাগজে মোড়া পাঁচটি রত্ন বের করে টেবিলের
ওপর, মতিলালের সামনে রাখলেন, বললে্ন,
‘এগুলো চিনতে পারছিস?’
মতিলাল দুটো পাথর হাতে নিয়ে পরখ করে বলল,
‘এ তো আমাদের রত্ন। একটু
ময়লা ধরেছে, পালিশ করলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এ পাথর আপনি পেলেন কী ভাবে? তাও
আংটি ছাড়া?’ কাত্যায়নশাস্ত্রী মতিলালের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আমি এগুলো পেয়েছি
শুক্রবার বিকেলের দিকে। কিন্তু যাঁদের রত্ন, তাঁরা আজ সকালে আমার কাছে এসেছিলেন’।
মতিলাল হাঁ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, বলল,
‘কী বলছেন, কিছুই বুঝছি
না। শুক্রবার কে আপনাকে এগুলো দিয়ে গেল? আর যাদের রত্ন তারা আজ সকালে কিসের জন্যে
এসেছিল’? কাত্যায়নশাস্ত্রী গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন,
‘আজ সকালে যাঁরা
এসেছিলেন, তাঁরা বললেন, গত শুক্রবার ভোরবেলা হাইস্কুল মাঠের পাশে, মর্নিং ওয়াক
করার সময়, তাঁদের কিছু টাকাপয়সা, গয়না-ঘড়ির সঙ্গে, এই পাঁচটি রত্ন বাঁধানো আংটিও
ছিনতাই হয়েছিল। এঁরা কিন্তু মিথ্যে কথা বলার লোকই নয়। সাধারণ ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা’।
‘কী সর্বনাশ। তাহলে
শুক্রবার বিকেলে আপনাকে এগুলো কে দিয়ে গেল?’
‘তার নাম শুনলে চমকে
যাবি! বিশ্বাসই করবি না। লোকটাকে কোনদিনই আমার সুবিধের লাগত না। কিন্তু এখন মনে
হচ্ছে, লোকটাকে আমি যতটা মনে করতাম, তার থেকেও ভয়ংকর!’
'কে বলো তো?’
‘বিপিন পুনিয়া’।
‘কী বলছেন, মহারাজজি? লোকটা
ধুরন্ধর জানি, তাই বলে এতটা নীচ? বজ্জাতটা ছিনতাই করে?’
‘ধুর পাগল, নিজে করে
নাকি? মনে হচ্ছে, লোককে দিয়ে করায়। ও চোরাই মাল পাচার করে, আর চুরির ভাগ নেয়। ওকে
সকলে চেনে, প্রফুল্লনগরে ওর একটা সুনাম আছে, কেউ সন্দেহ করবে না, বুঝলি না?’
‘আপনি নিশ্চিত?’
‘তা নই, কিন্তু আজ সকালে
ভদ্রলোকের মুখে সব কথা শুনে আমার সন্দেহ হচ্ছে’।
‘তা আপনাকে, ওই রত্নগুলো
দেবার সময় পুনিয়া কী বলল’?
‘বলল, ওদের পূর্বপুরুষের
কার বাক্সে নাকি এগুলো ছিল। এগুলোকে পালিশ করে, আবার ধারণ করলে কোন ফল হবে কি না’।
‘ডাঁহা মিথ্যে কথা। এই সবকটা
রত্ন আমার হাতের জিনিষ। আমি একদম নিশ্চিত’।
‘হুঁ। আমি তখন অত গুরুত্ব
দিইনি। ভেবেছিলাম হতেও পারে, ওরা রাজস্থানী তো, ওদের কাছে সোনাদানা, রত্ন-টত্ন
থাকতেই পারে। সত্যি বলতে আমি ভুলেই গেছিলাম, আজ সকালে ভদ্রলোক আর মহিলা এসে বলাতে,
ওগুলোর কথা মনে পড়ল এবং তখনই আমার সন্দেহ হল। তাই তোকে ডাকলাম’।
‘এগুলো নিয়ে কী করবেন,
এখন? ওই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাকে ফেরত দিয়ে দেবেন?’
‘পাগল হয়েছিস? আর বিপিন
যদি এসে বলে, ওগুলো ওর রত্ন, প্রমাণ করতে পারবি, যে ওগুলো ওর নয়? আর আমি যদি এখন
ওঁনাদের ফেরত দিতে যাই, ওঁনারা ভাববেন আমিই ওই ছিনতাইদলের সর্দার। এখন ধরা পড়ার ভয়ে সাধু
সাজছি’।
‘তাহলে?’
‘সেটাই ভাবছি। কিছু একটা
করা দরকার, তা নাহলে বিপিনের কিচ্ছু হবে না, কিন্তু আমি ধনে মানে শেষ হয়ে যাবো।
কিন্তু কী করা যায়?’ কাত্যায়নশাস্ত্রী ভাবতে লাগলেন। মতিলাল একটু বসে থেকে বলল,
‘মহারাজজি, আমি এখন উঠি,
দোকানে আমার ছোটভাইকে বসিয়ে রেখে এসেছি, দেখি কী করছে। এদিকে আমি খবর-টবর করছি,
জানলে আপনাকে বলব’।
‘বিপিনের নামটা আবার যেন
চাউর করিস না!’
‘না, না। ও বিষয়ে আপনি
নিশ্চিন্ত থাকুন’।
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে,
মতিলাল চলে গেল। চেম্বারে একলাই বসে রইলেন কাত্যায়নশাস্ত্রী। তিনি অন্যকে
দুশ্চিন্তা থেকে, বিপদ থেকে উদ্ধার করেন, কিন্তু এখন তিনিই নিজের দুশ্চিন্তায় ডুবে
রইলেন।
‘মতিলালকে সব কথা খোলসা
করে বলে ফেলাটা উচিৎ হল না, মনে হচ্ছে’।
নির্জন ঘরে, রুকু-সুকুদের
এই কথায় কাত্যায়নশাস্ত্রী প্রথমে একটু চমকে উঠেছিলেন। তারপর গলা চিনতে পেরে,
হাসলেন, বললেন,
‘ওফ চমকে দিয়েছিলে,
ভুতভাইরা! অনেকদিন দেখা হয়নি। ওইয্যাঃ ভুল বললাম, দেখতে তো পাই না, শুধু কথাই
শুনি - সেটাও শোনা যায়নি। মতিলালের ব্যাপারটা কি বলছিলে, ভাই?’ রুকু বলল,
‘বিশ্বাস করে সব কথাই তো
বলে দিলেন, এখন ও যদি বিপিন পুনিয়ার সঙ্গে যোগসাজশ করে ফেলে?’
‘ওর কী লাভ? মতিলাল আমার
থেকে কত ব্যবসা পায় জানো?’
‘জানি তো। সেই জন্যেই তো
বলছি। একই রত্ন যদি মতিলালের হাতে বার বার ফিরে আসে, আর প্রত্যেকবারেই, একটু পালিশ
দিয়ে, পুরো দস্তুর দামে যদি বিক্রি করে, ওর ক্ষতি হবে, না লাভ হবে? সেই লাভের থেকে
বিপিনকে যদি অর্ধেক ভাগ দেয়, বিপিনের ছিনতাইয়ের ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে উঠবে যে!’
‘তোমরা কী নিশ্চিত বিপিন
পুনিয়া এই ছিনতাইয়ের কারবারে যুক্ত’?
‘পুরোপুরি নিশ্চিত। ওর সঙ্গে আর যারা আছে,
সকলকেই জানি। তাদের নামও জানি, তাদের আস্তানা কোথায়, সেটাও আজ বিকেলের মধ্যে আশা
করছি জেনে যাবো’।
‘সর্বোনাশ, যদি তাই হয়,
মতিলালকে বলে তো ঠিক করিনি! ওরে বাবা, এদিকটা ভাবিনি তো? কিন্তু শুনেছি রত্ন একজন
কেউ ধারণ করার পর, অন্যের কাছে তার আর কোন ফল হয় না’।
‘সে তো আপনি জানেন।
সাধারণ মানুষ জানবে কী করে, কোনটা নতুন আর কোনটা পুরোনো? পালিশ করলেই তো চকচকে।
আরা দুটো পয়সার জন্যে যারা ওষুধের মধ্যেও ভেজাল মেশায়, তাদের কাছে পুরোনো রত্ন
গছানোটা কী এমন অন্যায্য বলুন দেখি?’
‘ঠিক কথা। কিন্তু যা হবার
তা তো হয়েই গেছে, ভাই। এখন এই বিপদ থেকে নিজে কী করে মুক্তি পাই এবং ওই বজ্জাত
বিপিনকেও কী করে জব্দ করা যায়, এমন কোন উপায় বাতলাও না, ভাই’।
‘আজ্ঞে, সেই উপায়ের
পরামর্শ করতেই তো এসেছিলাম, এসে দেখলাম, মতিলাল আর আপনি চা খাচ্ছেন। চুপ করে বসে
রইলাম, ওর পাশের চেয়ারে। তারপর কথাবার্তা যা বললেন, সে সবও শুনলাম। এখন মতিলাল যদি
বিপিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেলে, ব্যাপারটা আরেকটু জটিল হয়ে উঠবে। কাজেই, দেরি না
করে, আপনি বিপিনকে চট করে একটা ফোন করে ফেলুন দেখি’।
‘বিপিনকে ফোন করবো? কী
বলব?’
‘বলবেন, খুব জরুরি
ব্যাপার, আপনার চেম্বারে তাড়াতাড়ি একবার আসতে’।
ফোন তুলে বিপিনের নাম্বার
সার্চ করতে করতে কাত্যায়নশাস্ত্রী ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলেন,
‘ভুতভাইরা? এ যে একেবারে
সিংহের গুহার মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছি মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হবে কি? যদি জিগ্যেস করে
কেন?’
‘বলবেন, খুব গোপন কথা,
ফোনে বলা যাবে না। সামনাসামনি বসতে হবে’।
দুবার বিজিটোন পাওয়ার পর,
তিনবারে বিপিনের ফোন বাজতে লাগল। তারপর কথাও হল কাত্যায়নশাস্ত্রীর সঙ্গে। বিপিন
বলল, এখন অন্য কাজে একটু ব্যস্ত আছে, ঘন্টা খানেকের মধ্যে আসছে। ফোনে কথা শেষ হতে,
রুকু বলল,
‘এবার একবার মতিলালকেও
ফোন করুন। ওকে বলুন বিপিনের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে, ঘন্টা খানেক পরে মতিলালও যেন
এখানে চলে আসে’।
‘এই বলছেন, মতিলালকে
বলাটা ঠিক হয়নি, আবার বলছেন মতিলালকে ডাকতে, ভুতভাই গণ্ডগোল বাধিয়ে ফেলবেন মনে
হচ্ছে!’
‘না, না, শাস্ত্রীজি।
ঘাবড়াবেন না। মতিলাল তো আর জানে না, আপনার সঙ্গে বিপিনের কী কথা হয়েছে? এই ঘন্টাখানেকের
মধ্যে সে যদি ফোন নাম্বার যোগাড় করে, বিপিনকে সব কথা জানিয়ে দেয়? তার আগেই আপনি
জানিয়ে দিন, আপনার সঙ্গে বিপিনের কথা হয়ে গেছে, সে এখানে আসছে। তাহলে মতিলাল আর
ফোন করে বিপিনকে কোন কথা বলতে সাহসই করবে না’।
‘ওফ মাথা বটে, ভুতভাই,
ঠিক বলেছেন, এখনই করছি’।
‘হুঁ, তাড়াতাড়ি করুন,
বিপিন আসার আগে আপনার অনেক কাজ আছে আমাদের সঙ্গে। পরামর্শ আছে, প্রস্তুতি আছে।
চটপট সেরে ফেলতে হবে, সেগুলো’।
ফোন করে কাত্যায়নশাস্ত্রী
বিপিনের খবরটা দিতে, খুব অবাক হল মতিলাল। বলল,
‘দুম করে একটা কী
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন বলুন, দেখি? ওসব লোকের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখাই ভালো। তাকে
আপনি আবার ডেকে আনছেন? কী বলবেন ওকে, শুনি?’ উত্তরে কাত্যায়নশাস্ত্রী বললেন,
‘যা বলার তোর সামনেই তো
বলবো। আয় না’।
‘না মহারাজজী, আমি ওসব
লোকের সংস্রবে নেই। আপনার ঝামেলা আপনিই সামলে নিন’।
‘আসবি না, তাহলে?’
‘না মহারাজজি, ও সময়ে
দোকানে খুব ভিড় থাকে, আমি যেতে পারবো না’।
‘ঠিক আছে’।
ফোনটা কেটে দিতেই রুকু
বলে উঠল,
‘ভালোই হয়েছে, একটা উটকো
লোক বিদেয় হয়েছে’। কাত্যায়নশাস্ত্রী বললেন,
‘মতিলাল লোকটা খারাপ নয়,
দেখলে তো?’
‘হে হে এতটা চট করে কোন
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন না, শাস্ত্রীজি। ওকে খারাপ তো আমরা বলিনি, শাস্ত্রিজি। আমরা
সন্দেহ করছিলাম, এমন হতে পারে। সে যাকগে, এখন যা বলি মন দিয়ে শুনুন। আপনাকে কী
করতে হবে, কী ভাবে করতে হবে। আমরা সর্বদাই আপনার পাশেই থাকবো, কিন্তু যা করার,
আপনাকেই করতে হবে’।
৭
ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসবে
বলেছিল, কিন্তু বারোটা বাজতেও বিপিন এলো না দেখে, কাত্যায়নশাস্ত্রী ব্যস্ত হয়ে
উঠলেন,
‘কী ব্যাপার বলো তো,
ভুতভাই? বজ্জাতটা আসবে তো?’ সুকু বলল,
‘ব্যস্ত হবেন না,
শাস্ত্রীজি। না এসে যাবে কোথায়? চারদিন আগে সে আপনাকে চোরাই মাল গছিয়ে গেছে, আপনি
এ কদিন কোন সাড়া শব্দ করেননি। আর আজ ফোনে একেবারে জরুরি তলব, তাও গোপন কথা! দৌড়ে
আসবে, দেখে নেবেন। বড়ো কোন ঝামেলায় ফেঁসে গেছে, আরেকটু ধৈর্য ধরুন’। রুকু বলল,
‘আর বারোটা বেজে গেলেই বা
ক্ষতি কী? আপনি তো ওর বারোটা বাজানোর ব্যবস্থাই করছেন!’
‘হে হে হে হে, বেশ বলেছো,
ভুতভায়া। বারোটা বাজানোই বটে। সাজগোজ সব ঠিক আছে তো?’
কাত্যায়নশাস্ত্রী অন্য
দিনের মতো নয়, আজ একেবারে তান্ত্রিকের বেশে বসে আছেন। পরনে লাল ধুতি, যাকে বলে
রক্তাম্বর। গলায়, আর দু হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে টকটকে লাল সিঁদুরের মোটা
তিলক। খালি গায়ে, লাল কাপড়ের উড়নি। সারা গায়ে রক্ত চন্দনের আঁচড়। অন্যদিন
কাত্যায়নশাস্ত্রীকে যে বেশে দেখে সবাই অভ্যস্ত, আজ এই বেশে দেখলে নির্ঘাৎ চমকাবে।
রুকু বলল,
‘একদম ঠিক আছে। এখন আপনার
কথাবার্তার ওপর বাকিটা নির্ভর করবে’।
‘ও নিয়ে তুমি একদম চিন্তা
করো না, ভুত ভাই। তোমাদের ভরসায়, প্রমথবাবুর মতো লোককেও চমকে দিয়েছিলাম, আর এতো
বিপিন! হে হে হে হে, আমিও কি সেই আগের মতো কার্তিক চন্দ্র হাতি রয়েছি? এ কবছরে
আমার মধ্যেও বেশ একটা ইয়ে, মানে কী বলব...?’ সুকু বলল,
‘বিভূতি বলছেন’?
‘ঠিক তাই, ভেতরে বেশ একটা
বিভূতি টের পাই’। রুকু আর সুকু মুখ টিপে হাসল। সুকু বলল,
‘ব্যস, এই
আত্মবিশ্বাসটুকুই এখন খুব দরকার’।
‘দূর দূর, আত্মবিশ্বাস
নয়, যাকে বলে কনফিডেন্স...বুঝেছো না?’
এই সময়েই দরজায় দুবার
টোকা পড়ল, আর দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে, বিপিনের মুখ দেখা গেল।
‘ভিতরে আসবো কি, মহারাজজি’?
তারপর কাত্যায়নশাস্ত্রীর
অনুমতির অপেক্ষা না করেই, বিপিন ঘরে ঢুকে পড়ল, বলল,
‘পরণাম মহারাজজি। কুছু
দের হোয়ে গেলো আসতে। সোকাল থেকে এমোন পরেসানি, কী বোলবো? হামার সোময়টা একদম ভালো
যাছে না’।
কাত্যায়নশাস্ত্রী কিছু
বলবেন ভেবে, বিপিন চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু কাত্যায়নশাস্ত্রী কিছুই বললেন না,
কটমট করে, একদম সোজা তাকিয়ে রইলেন, বিপিনের দিকে। কাত্যায়নশাস্ত্রীর ওই বেশ আর ওই
কড়া দৃষ্টির সামনে বিপিন কিছুটা যেন দমে গেল। যে স্বাভাবিক স্বরে সে কথা শুরু
করেছিল, সেটা যেন কিছুটা মিইয়ে গেল, বিপিন আবার বলল,
‘কাল রাত্রে হামার কুছু মাল
লিয়ে ছোটা একটা ট্রাক কলকাতা রওয়ানা কোরিয়েছিলোম। আর আজ ভোরে খবর পেলোম কী, হাইওয়েতে
সেই ট্রাক পলটি হয়ে গেছে। ওই মালের মধ্যে লুকোনো কুছু নোটের বস্তাভি ছিল! ট্রাক পলটিভি
হোলো, আর নোটের বস্তা-উস্তা ফেটে-ফুটে ছড়িয়েভি পোড়লো। আর ওই দেখে লোকাল পিপুল ঝটসে
পুলিশে খবরভি দিয়ে দিলো! একবার ভি সোচলো না কী, পুলিশে খবর দিলে কী হোবে? নোট
পেয়েছিস, ঘরে লিয়ে যা, হামার নুকসান যা হবার হোত, হোত! কিন্তু এখোন আমার নোটভি
গেল, পুলিশভি পাকড়ালো!’
কাত্যায়নশাস্ত্রী তাও কোন
উত্তর দিলেন না, একইভাবে তাকিয়ে রইলেন। বিপিন এবার টেবিলে ভর দিয়ে, সামনে ঝুঁকে
জিগ্যেস করল,
‘কুছু তো বোলুন,
মহারাজজি। হামার জন্যে কুছু তো সোচুন’।
রুকু-সুকুও একটু অবাক হয়ে
যাচ্ছিল, কাত্যায়নশাস্ত্রী কোন কথা না বলায়! কী হল? উনি কথা বলছে না কেন? বিপিন
আবার খুব কাতর হয়ে বলে উঠল,
‘মহারাজজি, হামার কুছু
ওন্যায় হোলো কী? কুছু তো বোলুন। কুছুতো উপায় বাতলান! যো কোরতে বোলবেন, কোরবো, যোতো
পূজা, হবন, যাগ যজ্ঞ, সোব কোরবো...’। কাত্যায়নশাস্ত্রীর ঠোঁট নড়ে উঠল, বললেন,
‘মহাপাপী’। কথাটা তিনি আস্তেই বললেন,
রুকু-সুকু একদম পাশে দাঁড়িয়েছিল বলে, শুনতে পেল, বিপিন শুনতে পেল কিনা, সন্দেহ
আছে! বিপিন আরেকটু সামনে এগিয়ে এল, মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, আরো কিছু শোনার জন্যে,
আর তখনই যেন বোমা ফাটালেন, কাত্যায়নশাস্ত্রী, বলে উঠলেন,
‘লোভী! পাষণ্ড! পিশাচ!’
চুপচাপ স্থির হয়ে বসে থাকা কাত্যায়নশাস্ত্রীর গলা থেকে এমন বাজখাঁই আওয়াজ বেরোবে
কেউ ভাবতেই পারেনি। বিপিন তো ভয়ংকর চমকে পিছোতে গিয়ে, চেয়ার উলটে পড়েই গেল মেঝেয়।
রুকুসুকুও এমন চমকাল, ছিটকে সরে গেল, বেশ খানিকটা তফাতে। কাত্যায়নশাস্ত্রী এবার
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, মেঝেয় উলটে পড়ে থাকা বিপিনের দিকে তাকিয়ে, হিসহিসে গলায়
বলতে লাগলেন,
‘নিরীহ মানুষের চোখের জল
নিয়ে ব্যবসা করছিস? মেয়েদের সম্মান নিয়ে ব্যবসা করছিস? কী ভেবেছিস? পূজা আর হবন
করলেই তারামা তোকে ক্ষমা করে দেবে?’ এবার যা হল, তাতে অশরীরি রুকুসুকুও ভয়ে শিউরে
উঠল,
‘ধ্বংস হবি, ভিখিরি হয়ে
যাবি, তারামা আমাকে সব বলেছেন, তোর দিন ঘনিয়ে এসেছে রে’।
এই কথাগুলো কাত্যায়নশাস্ত্রী
খুব চেঁচামেচি করে বললেন, বা হাঁকডাক দিয়ে বললেন, তা কিন্তু নয়। তাঁর উদাত্ত স্বরে
এমন কিছু ভারভারিক্কি ব্যাপার ছিল, তাতে গায়ের লোম অব্দি খাড়া হয়ে উঠল বিপিনের।
বিপিন উল্টোনো চেয়ার থেকে হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠে এসে, ধড়াস করে শুয়ে পড়ল
কাত্যায়নশাস্ত্রীর পায়ের ওপর, দুই পা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘মুঝে মাফ কর দিজিয়ে,
মহারাজ। মাফ কর দিজিয়ে, মুঝসে বড়ি গলতি হো গয়ি হ্যায়। মেরে কিয়ে কা সাজা মিল রহি
হ্যায়, মুঝে মাফ কর দিজিয়ে’।
কাত্যায়নশাস্ত্রী এক
ঝটকায় বিপিনের হাত থেকে পাদুটো ছাড়িয়ে নিলেন। তারপর টেবিলের বাঁদিকের ড্রয়ার থেকে
কাগজের সেই মোড়কটি বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। মোড়ক খুলে পাঁচটি রত্ন মেলে ধরে
বললেন,
‘শুধু মাফ চাইলেই হবে না,
রে পিশাচ। ওঠ, পরশুদিন অমাবস্যা তিথি, তার মধ্যে এই পাঁচটি রত্নের আংটি বানিয়ে,
তোর চেলা সঞ্জীবকে বলবি, এটা যার থেকে ছিনতাই করেছিল, তাকে আবার যেন ফিরিয়ে দিয়ে
আসে’। বিপিন আতঙ্কে থর থর করে কাঁপছিল। উঠে দাঁড়িয়ে কাগজের মোড়ক সমেত রত্নগুলো
তুলে নিল। তারপর নিচু হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
‘অঙ্গুটির রূপা তো গালিয়ে
ফেলেছি মহারাজ। অঙ্গুটির মাপ কী কোরে পাবো? ভদোরলোকের বাড়িভি চিনবো কী করে?’
কাত্যায়নশাস্ত্রী ডানদিকের ড্রয়ার থেকে তাঁর লেখা সেই বিধানপত্রটি বের করে,
বিপিনের হাতে দিলেন, তারপর আগের মতোই ভয়ংকরভাবে বললেন,
‘এতে নাম আছে, ঠিকানা
আছে, এরপর যা করার করবি, তুই। আর মনে রাখিস, পরশু অমাবস্যা, তারপরে যা হবে...’
কথাটা শেষ করলেন না কাত্যায়নশাস্ত্রী, দরকারও ছিল না। তাতেই শিউরে উঠল বিপিন।
বিপিন আরেকবার কাত্যায়নশাস্ত্রীকে প্রণাম করল, তারপর কাঁপতে কাঁপতে দরজার দিকে
এগোলো। দরজার সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করল,
‘সঞ্জীবের নাম আপনি কী
করে জানলেন, মহারাজজি?’ কাত্যায়নশাস্ত্রী কিছুক্ষণ কোন কথা বললেন না, বিপিনের দিকে আগের মতো একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।
তারপর হঠাৎ যেন ধমকে উঠলেন,
‘তারা মা, তাড়া, তাড়া। মা,
মা, এই পাষণ্ড পিশাচদের নিকেশ করে দে, মা’। সেই ধমকে দরজা খুলে ছিটকে বেরিয়ে গেল
বিপিন।
বিপিন বেরিয়ে যাওয়ার পর,
কাত্যায়নশাস্ত্রী নিশ্বাস ফেলে নিজের চেয়ারে বসলেন, বললেন,
‘কী রকম হল, ভুতভায়া?
যেমন বলেছিলে তেমনই হয়েছে?’ সুকু বলল,
‘হয়েছে মানে? আমাদের
সবটাই হাওয়া, পিলে নেই, সেই আমাদেরও পিলে চমকে উঠেছিল!’
‘হাহা হাহা’ খুব খানিক
তৃপ্তির হাসি হেসে কাত্যায়নশাস্ত্রী বললেন, ‘কী মনে হচ্ছে? ওষুধ ধরবে বলে, মনে
হয়?’
‘আলবাত ধরবে। না ধরলে,
আরেক ডোজের ব্যবস্থাও আপনাকে বলে দেব’। সুকু বলল।
‘সুকু, আমাদের এখনি
বেরিয়ে পড়া দরকার, এই ঘটনার পর বিপিনের মতলবটা জানা, আমাদের খুবই দরকার’। সুকুকে
রুকু মনে করিয়ে দিল।
‘ঠিক বলেছিস। শাস্ত্রীজি,
আমরা এখন আসছি। কী খবর হচ্ছে আপনাকে জানাবো’।
‘ওক্কে ব্রাদার’।
৮
সন্ধ্যের পর সবাই বাড়ি
ফিরে আসার পর, সবাই বারান্দায় বসেছিল। নানান কথা বার্তার মধ্যে সরুদা বলল,
‘তিনদিন হতে চলল,
রুকু-সুকুর পাত্তা নেই কেন? ছেলেদুটো বেশ চিন্তায় ফেলে দিলে’!
‘কেন? তুই কী ওদের কোন
কাজ দিয়েছিলি নাকি?’ মেসোমশাই জিগ্যেস করলেন।
‘হুঁ। সেরকমই। তবে সে তো
যা করবে, দিনের বেলাতে। রাত্রের দিকে একবার এসে খবর তো দিতে পারে’? সরুদার এই
কথায়, মাসিমা বললেন,
‘তোর যেমন কথা, সরু।
গতকাল গেছে কৃষ্ণা চতুর্দশী, আর আজ ঘোর অমাবস্যা, এই সব দিনে ওদের কী আর দম ফেলার
সময় থাকে?’ অবাক হয়ে সরু জিগ্যেস করল,
‘কেন? এই সব দিনে ওরা কী
রাজকাজ করে, শুনি?’ মাসিমা একটু বিরক্ত গলাতে বললেন,
‘সে সব আলোচনা এখন না
করাই ভালো। তোকে আরও বলি, ওদের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করিস না, সরু। সেদিন দেখলাম, ওদের
দুজনের সঙ্গে তুই একদম মাথা গুঁজে কী সব কথা বলছিলি! তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা, আর
কৃষ্ণা দ্বাদশীর নিশুতি রাত। ওসব ভালো নয়, কী থেকে কী হয় বলা যায়?’
‘আচ্ছা, সরুদা তুমি সেদিন
ওদের সঙ্গে কুমীরের কথা কী বলছিলে, শুনলাম?’ টুম্পি জিগ্যেস করল সরুদাকে। খুব
খানিক হেসে সরুদা বলল,
‘দূর বোকা, ওদের সঙ্গে
কুমীর নিয়ে কী কথা বলব? হে হে হে, যা হাই তুলছিলি তখন, তাই বলেছিলাম, হাই তোলার
সময় মানুষকেও কুমীরের মতোই দেখায়’। টুম্পি রেগে লাল হয়ে উঠল, বলল,
‘কী, আমাকে তুমি কুমীর
দেখলে?’
‘খুব ছোট্ট বেলায়
বাবা-মার সঙ্গে একবার চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম, তখন অনেক কুমীর দেখেছিলাম’।
পেয়ারা গাছের নিচ থেকে,
হঠাৎ রুকুর গলা পাওয়া গেল। সরুদা চমকে উঠে তাকাল, বলল,
‘অ্যাই তো, রুকু-সুকু এসে
গেছে। দুদিন তোরা ছিলি কোথায়, ভাই? একটু আগেই তোদের নিয়ে কথা হচ্ছিল, কী খবর কি?
সব ঠিক ঠাক আছে?’ রুকু-সুকু একগাল হেসে বলল,
‘সব ঠিকঠাক হয়েছে, দাদা।
যেমনটি বলেছিলেন, আমরা তেমনটিই ঘটিয়েছি’।
‘ভেরি গুড। এখন ছোট্ট করে
কাত্যায়নশাস্ত্রী আর বিপিনের সাক্ষাৎটা কেমন হয়েছিল সেটা আগে বল দেখি?’
ঘটনাটা বর্ণনা করতে,
সুকুর আধঘন্টা মতো লাগল। সকলেই এত অবাক হয়ে শুনছিল, কেউ কোন কথা বলল না। সুকুর কথা
শেষ হতে, মাসিমা বললেন,
‘সেদিন মাঝরাত্রে তোরা এই
সব পরামর্শ করছিলি? তোদের ভয়ডর নেই? সাংঘাতিক সব লোক’।
‘ভয় পেলে পৃথিবীতে আদ্দেক
কাজই হতো না, মাসিমা। ভয় তো থাকবেই। আর আমি কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম, ঠিকই,
কিন্তু রুকু-সুকু যা করেছে তার তুলনা পাওয়া যাবে না’। রুকুসুকু লজ্জায় একটু দুলে
উঠল, বলল,
‘কী যে বলেন, দাদা? আপনার
বুদ্ধি ছাড়া আমরা কিচ্ছু করতে পারতাম না’।
‘ওই যে বিপিন পাঁচটা
চোরাই রত্ন কাত্যায়নশাস্ত্রীকে দিয়ে গিয়েছিল, সেটা তো আগে আমরা জানতাম না। ছিনতাই
হওয়া ওই ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা যে ওইদিন সকালে কাত্যায়নশাস্ত্রীর কাছে যাবে, সেটাও
আমরা জানতাম না। তারপরে কাত্যায়নশাস্ত্রী যে দুম করে মতিলালকে ডেকে সব কথা বলে
ফেলবে, এটাও তো আমরা জানতাম না। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি অনুযায়ী, তোরা যে ঠিকঠাক সব
কিছু সেরে ফেলতে পেরেছিস, সেটা কী কম কথা, রে’?
‘হে হে হে হে, আপনার
সঙ্গে থাকতে থাকতে আমরাও একটু শিখে ফেলছি, আর কি?’
‘তোদের তো হাওয়া বোঝাই
মাথা, তা নাহলে, একটা করে গাঁট্টা কষাতাম। সে যাকগে, সঞ্জীব আঙুলের মাপ নিয়ে, আংটি
বানিয়ে দিয়ে এসেছে’?
‘এই তো, একটু আগেই বাড়ি
গিয়ে দিয়ে এল। সেখান থেকেই তো আমরা আসছি। ছেলেদুটো খুব অভাবী, জানেন দাদা?
চাকরি-বাকরি নেই, বাড়িতে অসুস্থ বাবা-মা। বজ্জাত বিপিনের খপ্পরে পড়ে এই কাজে নেমে
পড়েছিল। আজকে সেই ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার পায়ে ধরে, ক্ষমা চেয়ে কেঁদেই
ফেলল। বার বার বলতে লাগল, আর কোনদিন এমন কাজ করবে না। ওদের কাজকর্ম কিছু একটা
দরকার, দাদা। কাজকর্ম করে, খেটেখুটে কিছু রোজগার হলে, এমন কাজ কেউ করে?’
কেউ কোন কথা বলছিল না।
চাপা কান্নার আওয়াজে সরুদা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, মাসিমা কাঁদছেন, আর শাড়ির আঁচলে নাক
চোখ মুছছেন। সকলেরই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর, সরুদা বলল,
‘মানুষের বিপদেআপদে পাশে
থেকে, সকলে মিলে যতটা পারি সাহায্য করতে পারি। কিন্তু কাউকে কাজকর্ম দেবার মতো
সাধ্য তো আমাদের নেই রে, রুকুসুকু। ও নিয়ে ভেবে শুধু মনই খারাপ হয়। ভালোয় ভালোয় আর
নির্বিঘ্নে এ কাজটাও উদ্ধার করা গেল, এইটাতেই শান্তি। আর একটা কথা সব সময়, মনে
রাখবি ভাল মনে ভাল কাজ করলে ভাগ্যও সহায় হয়। আগের দিন রাত্রে বিপিনের ট্রাক উল্টে
পুলিশের খপ্পরে পড়ে যাওয়াতে, আমাদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। বিপিন কোন রকম
ঝামেলা করার অবস্থাতেই ছিল না, এক কথায় সমর্পণ করে ফেলেছে। যাই হোক, মনে হচ্ছে,
নতুন কেউ আবার শয়তানি শুরু না করা পর্যন্ত, প্রফুল্লনগর কিছুদিন শান্তিতেই থাকবে’।
‘শাস্ত্রিজী একটা কথা
বলছিল, দাদা?’ খুব হাসি হাসি মুখে সুকু বলল।
‘কী বলতো?’
‘বলছিল, তোমরা দুভাই কোন
তান্ত্রিকের চেলা? আমার সঙ্গে যোগ দাও না ভাই, একসঙ্গে কাজ করি’।
‘তোরা কী বললি’?
‘বললাম, আমরা খুব বড় একজন
তান্ত্রিকের চেলা, তাঁকে ছাড়লে, আমাদের কপালে অশান্তি আছে’।
‘সেরেছে, সেটা আবার কে
রে?’
‘কেন? আমরাই তো আপনার
চেলা, আপনিই তো সেই তান্ত্রিক’!
রুকুসুকুর এই কথায়, সকলে খুব
হেসে উঠল হো হো করে। সরুদা রাগ রাগ ভাব করে দুজনের মাথায় গাঁট্টা ছুঁড়ল, কিন্তু
কোন লাভ হল না। গাঁট্টাদুটো হাওয়ায় ভেসে গেল। উল্টে রুকুসুকু মাথায় হাত বোলাতে
বোলাতে বলল,
‘ও সরুদা, আর মেরো না গো,
খুব লেগেছে গো’। বলে হাসতে লাগল খুব। এবার সরুদাও হেসে ফেলল, আর বাকি সবার হাসতে
হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার অবস্থা। সকলের হাসি থামলে, টুম্পি বলল,
‘সরুতান্ত্রিক কিন্তু
কালই চলে যাচ্ছে, রুকুসুকু’।
‘সত্যি? আপনি কালই চলে
যাচ্ছেন, সরুদা? কবে আসবেন আবার?’
‘সামনের ছুটিতে আসার
ইচ্ছে আছে, কিন্তু একজন গোমড়ামুখি হিংসুটি ঝগড়া না করলে, এসে আর কী লাভ’? এক কথা
থেকে সরুদা হঠাৎ যে কোন কথায় চলে যায়, বোঝা দায়। সরুদার মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই
দেখল, সে আড় চোখে টুম্পির দিকে তাকিয়ে আছে। আর টুম্পি তাই দেখে নাক বেঁকিয়ে মুখ
ঘোরালো। ওদের দুজনের রকমসকম দেখে সকলেই আবার হো হো করে হেসে উঠল, এমনকি টুম্পি
নিজেও!