Translate

শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ওঁরাই তাঁরা


"জয়ঢাক" ছোটদের ওয়েব ম্যাগে প্রকাশিত উপন্যাস




 আজ আমাদের বড়ো আনন্দের দিন। আমাদের বলতে আমাদের ফুটবল দলের কথা বলছি, যে দলের ক্যাপ্টেন আমি, নয়ন, ডাক নাম নানু। আমরা পোড়ামাতলা বরুণ সংঘের এই ফুটবল দল, এইবার নিয়ে মোট তিনবার চ্যাম্পিয়নের ট্রোফিটা আমাদের ঘরে তুললাম। গত দুবছরের মতো এবারও ওটা আমাদের ক্লাব ঘরের নড়বড়ে টেবিলে সারা বছর শোভা পাবে, এটা ভাবতেই আমাদের গর্ব হচ্ছে। আমাদের প্রতিপক্ষ পোড়ামাতলা আলোক সংঘ রানার্স হয়েছে!
আমাদের এই পোড়ামাতলায় বরুণ সংঘের খেলার মাঠটাই সবচেয়ে ভাল। মাঠের মাঝখানটাতে বেশ কিছু জায়গায় টাক পড়ে গেলেও, অন্য সবজায়গাতেই ঘাস আছে। মাঠের পশ্চিম দিকে বাঁশের খুঁটির গোলপোস্ট। আর উল্টোদিকে, মানে পুবদিকে হাজরাচৌধুরিদের বিশাল উঁচু পাঁচিলের গায়ে আলকাতরা দিয়ে গোলপোস্ট আঁকা আছেপোড়ামাতলার সবচেয়ে ভালো মাঠ হলেও আমাদের মাঠটা কিন্তু সাইজে খুব বড়ো নয়, দু-দলের সাত-সাত করে চোদ্দ জনের বেশি খেলা যায় না। দু একবার আমরা এগারো জনের দল করে খেলার চেষ্টা করে দেখেছি, সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়। হাতে পায়ে যেন জড়িয়ে যায়। ঘোরাফেরা করার জায়গা পাওয়া যায় না।
স্কুলের গরমের ছুটিতে আমাদের এই পোড়ামাতলার চোদ্দখানা ক্লাব মিলে একটা লিগ ম্যাচ হয়। বহুদিন ধরেই এই ফুটবলের লীগ ম্যাচ চলছে। এর চ্যাম্পিয়ন ট্রোফিটা বিশাল সাইজের আর দারুণ দেখতে। “ঈশ্বরী প্রভাবতী দেবী স্মৃতি পোড়ামাতলা ক্রীড়া উন্নয়ন সমিতির” পক্ষ থেকে এই ট্রোফিটি লীগের চ্যাম্পিয়নকে দেওয়া হয় একবছরের জন্যে। বছরভর চ্যাম্পিয়ন ক্লাবের টেবিলের ওপর শুকনো ফুলের মালা পড়ে এই ট্রোফি সাজিয়ে রাখা থাকে। পরের বছর লীগ শুরুর আগে এই ট্রোফি আবার চলে যায় ক্রীড়া উন্নয়ন সমিতির অফিসে।
আমাদের মাঠের পুবদিকে যে হাজরাচৌধুরিদের উঁচু পাঁচিলের কথা বললাম, ঈশ্বরী প্রভাবতী দেবী ওই বাড়ির মেজদার মা ছিলেন। মেজদা মানে রজনীকান্ত হাজরাচৌধুরীকে আমরা কোনদিন দেখিনি, আমাদের বাবা-কাকাদের কাছে শুনেছি। মস্তো বড়োলোক আর খুব দিলদরিয়া মানুষ ছিলেন। পোড়ামাতলায় ওঁনাদের পরিবারের কেউই আর এখন থাকেন না। লোকে বলে ওঁনারা কেউ মুম্বাইতে, কেউ দিল্লিতে, কেউ আমেরিকায় থাকেন। অনেকদিন আগে কোন এক দুর্ঘটনায়, এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল ওঁনাদের পরিবারটা। আমাদের ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, বরুণ সংঘের মাঠের পুবদিকে বিশাল বাগানওয়ালা হাজরাচৌধুরিদের বাড়িটা, পোড়ো বাড়ি হয়েই পড়ে রয়েছে কেউ কোনদিন আসেও না, থাকেও না কেউ। ওই বাড়িটা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে, আমরা কান দিই না। আর পারতপক্ষে ও বাড়ির ভিতরেও ঢুকি না। বিকেলে খেলার সময় পাঁচিল টপকে কোন বল ওপারে গিয়ে পড়লে, পরদিন সকালে আমরা চারপাঁচজন মিলে সেটাকে উদ্ধার করে আনি। ব্যস, ওই পর্যন্তই।
আজ আধঘন্টা আগে আমাদের ফাইন্যাল ম্যাচ শেষ হল। তারপর ছিল পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। সব কিছু মিটে যাওয়ার পর আমরা কজন মাঠের ধারে বসেই, খেলা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আমরা কজন বলতে, এখন আমরা সাতজন আছি -  সেন্টু, বিলে, কাতু, বিজু, ভানু, মিলন আর আমি। ভানু আর মিলন আজ খেলেনি, ওরা এক্সট্রা হিসেবে ছিল, আমাদের কেউ চোট-টোট পেয়ে বসে গেলে, ওরা খেলতে পারতআমাদের মধ্যে এখন নেই ভুতো আর পিল্লে। ওরা দুজন পুরো সময়টাই খেলল, কিন্তু খেলা শেষ হতেই হুট করে বাড়ি চলে গেল!
তবে হ্যাঁ, আজকে এই ফাইন্যালের দিন, ভুতো আর পিল্লে যা খেলল, ওফ্‌ দেখার মতো। ওরা দুজন মোক্ষম দিনে এমন না খেললেও আমাদের হাতে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি হয়তো আসত। কিন্তু প্রতিপক্ষ দলকে এমন দুরমুশ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে আলাদা আনন্দ, সেটা টের পেতাম না। আজকে টিমের সকলেই ভালো খেলেছে, ক্যাপ্টেন হিসেবে আমিও মন্দ খেলি নি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে ওদের দুজনের দুর্দান্ত খেলা, ভাবা যায় না।
সাধারণতঃ ফাইন্যাল ম্যাচ খুব মানসিক চাপের খেলা হয়, দুটো দলের মোটামুটি একই রকমের শক্তি। খুব হাড্ডাহাড্ডি চলে। গোল-টোল কম হয়, প্রচুর ধাক্কাধাক্কি আর ফাউল হয়। গতবারও আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, মাত্র ৬-৩ গোলে জিতে। হাঁটুতে আর পায়ে চোট লেগে আমাদের দলের দুজন আর ওদের দলের তিনজনকে বসে যেতে হয়েছিল। আমাদের ভাগ্য ভালো ওদের দলের বদলি খেলোয়াড়রা তেমন ভালো ছিল নাহাফটাইমের পরেও প্রায় কুড়ি মিনিট পর্যন্ত আমাদের খেলার রেজাল্ট ছিল ৩-৩, শেষ দশ মিনিটে আমরা তিন গোল করে, ম্যাচটা বের করে নিয়েছিলাম। গতবারে ছটার মধ্যে চারটে গোল আমিই দিয়েছিলাম।
আজ সেখানে আমরা ১১-১ গোলে জিতেছি। ভাবা যায়? এবারের রানার্স আলোক সংঘ মোটেই এলেবেলে টিম নয়। গতবারও ওরাই রানার্স হয়েছিল। ওদের জীবন আর হারুতো মারাত্মক খেলে। কিন্তু এবারে খেলাটা পুরো বদলে দিলে ভুতো আর পিল্লে। আমাদের ছ’জন ছাড়া ওদের দলের পায়ে বল যেতেই দেয় নি। যতবার ওরা পায়ে বল পেয়েছে, পিল্লে গিয়ে তুলে নিয়েছে, আর পাস করেছে ভুতো নয়তো আমাকে অথবা সেন্টুকে। নিখুঁত পাস। একটু ভাঁজ দিয়ে গোলের মুখে ঠেলে দেওয়ার অপেক্ষা – গোল। ভুতো পাঁচটা, আমি তিনটে, সেন্টু দুটো আর পিল্লে একটা – মোট এই এগারোটা গোল!
 আমরা যে গোলটা খেলাম সেটা একদম অকারণ। খেলা শেষ হওয়ার মিনিট তিনেক আগে। সে সময় আমরা বুঝে গেছি, আমরাই এবার চ্যাম্পিয়ন। একধরনের আত্মতুষ্টি এসে গেছিল মনে, আর সেটাই গণ্ডগোল করে দিল। ওদের দলের জীবন পেনাল্টি বক্সের ফুট দশেক পেছন থেকে আমাদের গোলে শটটা নিয়েছিল। দুর্বল নিরীহ শট। আমার পাশ দিয়ে বলটা বেরিয়ে গেল, একটু চেষ্টা করলেই বলটা ডিফেণ্ড করা যেত। করলাম না, মনে হল, আর দৌড়ে কি হবে, গোলে বিজু আছে, ঠিক ধরে নেবে। ওদিকে অন্যদিকের বারে দাঁড়িয়ে বিজুও নিশ্চিন্ত ছিল, আমি নিশ্চয়ই বলটা ডিফেণ্ড করবো। কিন্তু ও যখন বুঝতে পারল, বলটা গোলেই ঢুকছে, তখন কয়েক সেকেণ্ড দেরি হয়ে গেছে। হাজরাচৌধুরিদের পাঁচিলে লেগে ফিরে আসা বলটা ধরে, ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। দোষটা আমারই।
খেলার ক্লান্তি, তারপর পুরষ্কার বিতরণীর ব্যস্ততার পর আমরা সাতজন মাঠের ঘাসে চুপ করে বসেই ছিলাম একসঙ্গে। আমাদের মাঝখানে রাখা ছিল আমাদের পুরষ্কার পাওয়া নটা ছোট ছোট কাপ। ছটা বইয়ের একটা প্যাকেট, সেন্টুর জন্যে। এবারে লিগের সবকটা ম্যাচ মিলিয়ে মোট আটত্রিশটা গোল দিয়ে, সেন্টুই সর্বোচ্চ গোলদাতা। দুটো বইয়ের আর একটা প্যাকেট ভুতোর, আজকের ফাইন্যাল ম্যচে সর্বোচ্চ পাঁচটা গোল দেওয়ার জন্যে। ভুতোর কাপ আর বইয়ের প্যাকেট আমিই নিয়েছি, ভুতোর হয়ে, সন্ধেবেলা ওর বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসব। ভুতো আর পিল্লে এমন হুট করে চলে গেল! যাবার আগে আমাকে একবার বলেও গেল না!
সকলেই চুপ করে আছে দেখে আমিই প্রথম কথা শুরু করলাম,
‘কি রে, সবাই এমন চুপ করে বসে আছিস, মনে হচ্ছে আমরাই যেন হেরো পার্টি। কেউ কিছু বলছিস না যে?’
‘পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন, এখনো ঠিক ভাবতে পারছি না’। সেন্টু উত্তর দিল, ‘ব্যাপারটা সত্যি তো?’
‘সত্যি মানে, একশোবার সত্যি। বিকাশদা আর সঞ্জয়দা এতক্ষণে ক্লাব ঘরে আমাদের পাওয়া ট্রোফিটা সাজিয়ে ফেলেছে, মনে হয়’। ভানু হাসতে হাসতে উত্তর দিল।
‘শুধু সাজানো? সঞ্জয়দা বলছিল, আজ সন্ধেতে পাড়ায় সবার বাড়িতে মিষ্টির প্যাকেট দেবে। এতক্ষণে মনে হয় ‘শুধু সন্দেশ’-এ অর্ডারও দিয়ে দিয়েছে!’ কাতু পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে বলল।
‘যাই বলিস, গত একমাস ধরে, আমরা যে একটানা খেলেছি, সে তো এই দিনটার স্বপ্ন দেখেই খেলেছি! আজ সেটা পুরো হল। দেখলি না, ভোলাজেঠু বললেন, বরুণ সংঘে গত ত্রিশবছরে টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন একবারও হয় নি’। কাতুর কথার জের টেনে আমি বললাম। ভোলানাথ সাঁতরা আমাদের ক্লাবের সভাপতি, আমরা ভোলাজেঠু বলি। আমার কথার উত্তরে সেন্টু বলল,
‘ঠিক বলেছিস, নানু। সারা গায়ে-পায়ে ব্যথা, কিন্তু তাও ভীষণ আরাম হচ্ছে। আজ যদি হারতাম, সেটা হতো না’।
‘কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার মনে একটা কাঁটা রয়ে গেল?’ আমি খুব নিচু স্বরে বললাম।
‘কি ব্যাপার রে, নানু?’ কাতু জিগ্যেস করল।
‘আমি জানি। নানু, আমাদের এক গোল খাওয়াটা নিয়ে ভাবছিস তো?’ মিলন বলল।
‘হুঁ। ওটা উচিৎ হয় নি। পুরোপুরি আমার দোষে, বিজু গোলটা খেয়ে গেল’। আমি বললাম।
‘ছাড় তো, একটাই তো গোল, এগারো তে এক – কি আসে যায়, এখন ওসব চিন্তা ছাড় না’ ভানু বলল।
‘না রে, খুব খারাপ হয়েছে। খেলার মধ্যে আত্মতুষ্টি ব্যাপারটা ভীষণ বাজে ব্যাপার, ওতে জেতার স্পিরিটটা হাল্কা হয়ে যায়’। আমি বললাম। আমার এই কথায় বিজু বলল,
‘খেলায় তো গোল হতেই পারে। কিন্তু অত সাধারণ একটা শট থেকে গোল খেয়ে গেলাম, ওটাই লজ্জার। তবে নানু, তুই নিজেকে পুরো দোষ দিস না। আমিও তো নিশ্চিন্তে উল্টোদিকের বারে দাঁড়িয়েছিলাম। সেটা আমারও তো ভুল হয়েছিল। আমি গোল কিপার, আমার উচিৎ সবসময় পজিশনে ঠিকঠাক দাঁড়ানো। দাঁড়াইনি, ধরেই নিয়েছিলাম, তুই ওটা রিসিভ করে নিবি। সেটাও তো একধরনের, ওই যে তুই বললি, আত্মতুষ্টি। আমারও একই দোষ হয়েছিল’  মিলন হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল,   
‘ছাড় না, যা হয়ে গেছে ভুলে যা। মানছি রেজাল্টটা ১১-০, কিংবা ১২-০ হলে আরো ভালো দেখাতো। একটা কথা বলতো, ভুতো আর পিল্লেটা আজ যে খেলাটা দেখাল, আগে কোনদিন দেখেছিস’?
‘সত্যি এরকম খেলা, ভাবা যায় না। অপোনন্টের কাউকে প্রায় বল ধরতেই দিল না! একটাও পাস, শর্ট কিংবা লং -  মিস করে নি। আর ভুতো যখন মাঠের লাইন ধরে সাঁসাঁ করে গোলের দিকে ঢুকছিল, কেউ দাঁড়াতে পারছিল না আশে পাশে। যেমন ডজ, তেমনি ড্রিব্‌লিং, আর সেরকমই বলের ওপর কন্ট্রোলগত দুবছর ধরে আমাদের সঙ্গে খেলে চলেছে ওরা, বিশ্বাসই হয় না’। আমি বললাম।
‘সত্যি দারুণ খেলেছে, দুটোতে’।  কাতু বলল।
‘দেখিস ওরা দুজন যদি খেলাটা এভাবে ধরে রাখতে পারে, অনেকদূর যাবে! পোড়ামাতলা ছেড়ে ওরা কলকাতা ক্লাবে সুযোগ পেয়ে যেতে পারে।’ আমি আবারও বললাম।  ভানু উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তোরা সব, খেলে চ্যাম্পিয়ন হলি, আমি আর মিলন না খেলেই চ্যাম্পিয়ন চল এবার যাওয়া যাক। বাড়ি গিয়ে ফ্রেস হয়ে আবার ক্লাবে আসবি তো?’ সন্ধে হতে চলল, খেয়ালই করিনি, আমিও উঠে পড়ে বললাম, 
‘ঠিক বলেছিস, এদিকে সন্ধেও হয়ে এলো। ক্লাবে তো আসবোই, তবে আমার একটু দেরি হবে। আমি আসার আগে ভুতো আর পিল্লের বাড়ি প্রাইজগুলো দিয়ে, ক্লাবে আসবো’।




বাড়ি ফিরে, প্রথমেই মাকে প্রণাম করে, আমার পাওয়া দুটো কাপ মায়ের হাতে দিলাম। তারপর জার্সি কেচে, স্নান সেরে, বাইরে বেরোনোর জামা প্যান্ট পড়ছি দেখে, মা জিগ্যেস করলেন,
‘এই তো চ্যাম্পিয়ন কাপ জিতে দুনিয়া উদ্ধার করে ফিরলি! এই তিন সন্ধে বেলা, আবার চললি কোথায়? বাড়িতে কী একদণ্ডও মন বসে না? ইচ্ছে হয় না, পড়ার বইগুলো নিয়ে বসতে?’
‘মা, আজকের দিনটাই তো! ক্লাবে যাবো, তার আগে একবার ভুতো আর পিল্লের বাড়িও যাবো’।
‘কেন ওরা আজ খেলে নি?’
‘পুরোটাই খেলেছে, কিন্তু প্রাইজ দেবার আগেই ফুড়ুৎ করে বাড়ি পালিয়েছিল! ওদের কাপ আর প্রাইজগুলো দিয়ে আসি’!
‘দেখে শেখ, নানু, দেখে শেখ। তোদেরই বন্ধু। খেলাও করে, আবার পড়ার টানে কেমন বাড়ি চলে গিয়েছে। তুই যে কবে এমন মানুষ হবি রে, নানু। সেদিন আমি নিশ্চিন্ত হবো’।  উত্তরে আমি খুব গম্ভীর হয়ে বললাম,
‘ও, এখন বুঝি আমি মানুষ, নই, মা?’
‘না তো, আস্ত বাঁদর একখানা। দিন রাত শুধু খেলা আর খেলা। তাও যদি বুঝতাম মোহনবাগান কি ইষ্টবেঙ্গলে খেলছিস, দেশ জোড়া নাম’। মায়ের এই কথায় এবার আমি হেসে ফেললাম, বললাম,
‘মা, মোহনবাগান বা ইষ্টবেঙ্গলে যাঁরা এখন খেলেন, তাঁরাও ছোটবেলায় আমাদের মতনই খেলতেন, আর তাঁদের মায়েরাও এমনই বলতেন, জানো তো’?
‘আচ্ছা, আচ্ছা। নে খুব হয়েছে। তাড়াতাড়ি ফিরবি কিন্তু। দেরি হলে তোর বাবা কিন্তু খুব রাগ করে, সে আমি সামলাতে পারবো না, বাপু’।
আজকে পাওয়া আমার কাপদুটো শাড়ির আঁচল দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে মা বললেন। একটা ছোট কাপ, সবাই পেয়েছে, চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়দের প্রত্যেকের জন্যে। আরেকটা একটু বড়, এবারের সেরা ক্যাপ্টেন হিসেবে। আমি জানি, মা বসার ঘরের আলমারিতে আমার খেলায় পাওয়া অনেক কাপের সঙ্গে এদুটোও সাজিয়ে রাখবেন। নিজে হাতে মাঝে মাঝে পরিষ্কারও করবেন।
ছোট একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভুতো আর পিল্লের প্রাইজগুলো ভরে, আমি মাকে বললাম,
‘আসছি, মা’।
‘আয়। বেশি দেরি করবি না, কিন্তু। আজকে তোর জন্যে চিকেন আনাচ্ছি, আর রসগোল্লার পায়েস বানাবো, তুই ভালোবাসিস’




ভুতোর বাড়িতে গিয়ে দেখি, বাইরের বারান্দায় ভুতো গোমড়া মুখে বসে আছে। আমি ঢুকেই বেশ বিরক্ত মুখে জিগ্যেস করলাম,
‘তোরা কী রে? হুট করে না বলে চলে এলি? সবাই মিলে একসঙ্গে ট্রোফি নেওয়া হল, ছবি তোলা হলতোরা দুজনেই নেই! ওভাবে কেউ চলে আসে? এত কি জরুরি কাজ ছিল বল তো’?
ভুতো আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর খুব মিহি চিঁচিঁ করা স্বরে বলল,
‘কনগ্রাচুলেসানস, নানু। বিশ্বনাথদা বাড়ি যাচ্ছিল এখান দিয়ে, ওর মুখে শুনলাম, আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি’।
‘আচ্ছা? তুই শুনলি? তুই জানতিস না? তুই পাঁচ-পাঁচ খানা গোল ঢোকালি ওদের পোস্টে আর তুই জানতেই পারলি না, আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি?’
‘বাজে বকিস না, নানু। সেই ভোর থেকে শুরু হয়েছে আমার বাথরুম যাওয়া, নাড়িভুঁড়িও মনে হয় আর পেটের মধ্যে নেই। নড়তে পারছি না। খেলা তো দূরের কথা, কথা পর্যন্ত বলতে পারছি না এর মধ্যে তোর এই এয়ার্কি ভাল্লাগছে না। তোরা সব কেমন খেললি বল আমার বদলি কাকে নামিয়েছিলি, ভানু না মিলনকে’?
এই কথাবার্তার সময়, কাকিমা, ভুতোর মা, বারান্দায় এলেন, হাতে একটি বড়ো বাটি নিয়ে। আমাকে দেখে বললেন,
‘নানু কখন এলে? শুনলাম তোমরা নাকি খুব ভালো খেলে আজ চ্যাম্পিয়ন হয়েছ? আর তোমার এই বন্ধুকে দেখ, কাল কোথায় কি ছাইপাঁশ খেয়ে এসে, আজ সকাল থেকে তার পেট খারাপ। সে এমন অবস্থা বাবা, গুরুপদ ডাক্তারকে ডাকতে হল। তিনি এসে তিন পুরিয়া ওষুধ দেওয়াতে একটু কমল। দুপুরের পথ্য গ্যাঁদাল পাতা দিয়ে মাগুরের ঝোল আর গলা গলা ভাত। সেই খেয়ে এই একটু আগে উঠে, বারান্দায় এসে বসেছে। ভুতো এটা খেয়ে নে তো, বাবা, ঢুক করে’।
‘কি ওটা?’ ভুতো মুখটা তেঁতো পাঁচন খাওয়ার মতো বেঁকিয়ে জিগ্যেস করল,
‘লেবু আর সামান্য চিনি দিয়ে বার্লি করে নিয়ে এসেছি, খেয়ে নে, পেটটা ঠাণ্ডা হবে’
‘ভাঁল্লাগছে না, খাঁবো না’বাচ্চাদের মতো ঘ্যান ঘ্যান করে ভুতো কাকিমাকে বলল। কাকিমা রেগে গিয়ে বললেন,
‘তা কেন ভালো লাগবে? ফুচকা, আলুকাবলি, হাবিজাবি ফুটপাথের খাবার খেতে ভালো লাগবে, ঘরে তৈরি বার্লি মুখে রুচবে কেন? ওতে যে পেট ভালো হয়ে যাবে! চট করে খেয়ে নাও, আমার রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। এখনো সন্ধে দেওয়া হয় নি, তোমার জন্যে এই সব করতে করতে’। আমিও চাপা স্বরে বললাম,
‘ভুতো, ঝামেলা বাড়াস না, নাক চোখ বন্ধ করে খেয়ে নে’। কাকিমার হাত থেকে বাটি নিয়ে এক চুমুকে শেষ করল ভুতো। কাকিমা খালি বাটিটা হাতে নিয়ে খুশি মুখে চলে যাওয়ার সময় বললেন,
‘নানু, তুমি একটু বসে তোমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলো তো, ওর মনটা একটু হাল্কা হবে’।
কাকিমা ঘরের ভিতর চলে যাওয়ার পর, আমি ব্যাগ থেকে দুটো বইয়ের প্যাকেট আর একটা ছোট কাপ বের করে ভুতোর হাতে তুলে দিয়ে বললাম,
‘আমি এখন আসছি রে, ভুতো। বইয়ের প্যাকেটটা আজকে তোর সবচেয়ে বেশি গোল দেওয়ার জন্যে, আর ছোট কাপটা আমাদের চ্যাম্পিয়ন দলের সকলের জন্যে। পরে তুলে রাখিস’। ভুতো চিঁচিঁ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
‘আমি খেললামই না, আর আমি সবচে বেশি গোল দিয়ে ফেললাম? নানু, তোরা ভুল করছিস। আমি আজকে খেলতে যেতেই পারি নি’। 
এবার আমি একটু বিরক্তই হলাম। ভুতো কাকিমাকে না জানিয়ে খেলতে গিয়েছিল, কাকিমার ঘুম ভেঙে যাওয়ার আগে বাড়ি ফেরার তাড়াতে আমাদের মাঠে বলে আসতে পারে নি। সব ঠিক আছে! কাকিমা তো এখন সামনে নেই, কিন্তু আমাকে এমন মিথ্যে কথা বলে, ওর কি লাভ হচ্ছে, কে জানে! আমি বললাম,
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমাকে আর বেশি বোঝাস না তো...’ ভুতো আমার কথায় কানই দিল না, নিজের মনে বলতে লাগল,
‘কাল তোর পাল্লায় পড়ে, কেন যে বিকেলে হারাধনদার ঘুগ্নি খেতে গেলাম, কে জানে? খাওয়ার সময়ই বুঝতে পারছিলাম, পেটটা ভোগাবে। সারারাত পেটের মধ্যে সে কি ধুন্ধুমার কাণ্ড! তার পর সকাল থেকে শুরু হল, টয়লেটে যাওয়া আর আসা, ওফ সে কি অবস্থা, বাপরে’।
আমি উঠে পড়লাম ভুতোর মিথ্যে কথার বহরে, আমি অত্যন্ত অবাক না হয়ে পারলাম না, বললাম,
‘তুই আজ খেলতে যাস নি, একটাও গোল দিস নি, আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি-তুই জানিস না, কাকিমার ভয়ে তুই এসব কথা বলছিলি, আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু কাল তোর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল সকাল সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত, তখন আমাদের দলের সবাই ছিলাম। সে সময় আমরা কিছুই খাইনি। তারপর কখন তোর সঙ্গে দেখা হল, যে তোকে ঘুগ্নি খাওয়ালাম?’ ভুতো অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘কাল তুই আমাকে ঘুগ্নি খাওয়াস নি?’ আমি বললাম ‘না’
‘আজ আমি মাঠে গিয়ে দারুন খেলেছি, পাঁচগোল দিয়েছি, কিন্তু খেলা শেষ হতেই পালিয়ে এসেছি মায়ের ভয়ে। তুই আমার প্রাইজের কাপ আর বইয়ের প্যাকেট নিয়ে এসেছিস। ঠিক?’
‘এক কথা কতোবার বলব, ভুতো? আমার মনে হয়, হয় তুই পাগল, নয়তো আমি। চললাম রে’।

মনের মধ্যে একটা খটকা নিয়ে পিল্লের বাড়ি গেলাম। সে আবার কি বলে, শুনি। পিল্লের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ ছিল। বেল দিতে কাকিমা দরজা খুলে দিলেন। কাকিমা আমাকে বেশ ভালোবাসেন, কিন্তু আজ আমাকে দেখেই কাকিমার মুখটা কেমন যেন বিরক্ত দেখালো। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন। পিল্লে না থাকলেও  সাধারণতঃ ভেতরে ডাকেন, বসতে বলেন, মায়ের খবর নেন। আজ কিছুই বললেন না। একটু ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলাম,
‘পিল্লে ঘরে নেই? কোথাও গেছে?’ কাকিমার স্বরে চরম বিরক্তি, বললেন,
‘ঘরেই আছে। কালকে পিল্লেকে গাছ থেকে ফেলে দিয়ে, কাউকে কিছু না বলে তুই অমন চলে গেলি? তুই না ওর বন্ধু?’ আকাশ থেকে পড়লেও আমি কম অবাক হতাম। আমি বললাম,
‘কি বলছেন, কাকিমা? কালকে আমি পিল্লেকে গাছ থেকে ফেলে দিয়েছি? কখন?’
ভ্রূ কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর কাকিমা বললেন,
‘বেশ মিথ্যে কথা বলতে শিখেছিস, তো? দাঁড়া তোর মাকে বলবছি ছি, এই তোরা সব বন্ধু?’
‘কাকিমা, কাল আমি কখন এসে পিল্লেকে গাছ থেকে ফেলে দিলাম? একটা কোথাও ভুল হচ্ছে’।
‘আবার মিথ্যে কথা? কাল তুই বিকেলে সাড়ে চারটে নাগাদ আসিস নি? আমাদের পিছনের জামগাছটাতে তুই আর পিল্লে চড়িস নি? গাছে ওঠার আগে তোদেরকে পই পই করে বারণও করলাম, গাছে চড়িস না, আজ তোদের ফাইন্যাল খেলা। পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙলে কি হবে? আমার কথা শুনলিনা। “কিচ্ছু হবে না” বলে দুজনে উঠলি...’
‘তারপর?’ আমার নিজের না করা অপকীর্তির গল্প শুনতে খারাপ লাগছিল না, বরং রোমাঞ্চ হচ্ছিল।
‘তারপর? বাঁদর ছেলে, পাকামি হচ্ছে! তারপর, একটু পরে হুড়মুড় শব্দ করে কী যেন পড়ল বাইরে। দৌড়ে এসে দেখি, পিল্লে গাছ থেকে পড়ে, পা মচকে কাৎরাচ্ছে, আর তুই পগার পার’।
কাকিমার এই কথায় আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে নিয়ে একটা মারাত্মক গণ্ডগোল হয়েছে ভুতো আর পিল্লের বাড়িতে। আর সেটা এখনই সমাধান না করতে পারলে, আমার সমূহ বিপদআমি সকলের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবো। আর আমার মা বাবারও সম্মান নিয়ে টানাটানি হবেআমি গম্ভীর হয়ে কাকিমাকে জিগ্যেস করলাম, 
‘পিল্লে কোথায়, কি করছে?’
‘পায়ে চূণহলুদ লাগিয়ে দিয়েছি, ওর ঘরে শুয়ে আছে’। কাকিমা বললেন।
আমি পিল্লের ঘরে গেলাম, কাকিমাও আমার পিছনে এলেন। পিল্লের পাশে ওর বিছানাতে বসলাম। পিল্লের ডানপায়ের গোড়ালি থেকে গোটা পায়ের পাতায় চূণহলুদ লাগানো রয়েছে। জিগ্যেস করলাম,
‘পায়ে খুব ব্যথা, না রে?’ পিল্লে ঘাড় নেড়ে বলল,
‘হুঁ’।
‘আজ তো তুই মাঠেও যাস নি, দুর্দান্ত খেলে, নিজে একটা গোলও দিস নি, তাই না?’
‘এই পা নিয়ে খেলা যায় নাকি? ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছি না। বাথরুম যাচ্ছি, মায়ের কাঁধে ভর দিয়ে’।
‘ঠিক কথা। কাল সকালে মাঠে বসে আমরা দশটা থেকে এগারোটা টিম মিটিং করেছিলাম, পিল্লে তোর মনে আছে? আমরা কী ঠিক করেছিলাম মনে আছে?’ আমার এই কথায় পিল্লে উত্তর দিল,
 ‘হ্যাঁ। মনে আছে। তুই বলেছিলি, আজ সারাদিন আমরা বিশ্রাম নেবো। কালকে খেলার জন্যে শরীর আর মনের দিক থেকে সব্বাই চাঙ্গা থাকবো। খেলায় হার জিত আছেই, সেটা বড়ো কথা নয়। কিন্তু আমরা কাল সব্বাই লড়ে যাবো। আমাদের সবার সেরা খেলাটা আমরা কালকে ফাইন্যালের দিন খেলে নেব’।  আমি বললাম,
‘ঠিক। কিন্তু তারপর আমি বিকেলে এসে তোকে জামগাছে তুলে, ঠেলে ফেলে দিলাম, যাতে তুই আজ খেলতেই না পারিস।  আরো আছে, এই মাত্র ভুতোর বাড়ি গিয়েছিলাম, সেও বলল আমি নাকি তাকে বিকেলে হারাধনের ঘুগ্নি খাইয়ে পেট খারাপ করে দিয়েছি। সেও আজ সারা দিন ঘরেই বসে ছিল, সকাল থেকে এতোবার বাথরুম গেছে, তার দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না, খেলা তো অনেক দূরের কথা!’ আমি একটু চুপ করলাম, কাকিমা আর পিল্লের মুখের দিকে তাকালাম, দুজনেই অবাক হয়ে আমার কথা শুনছেনআমি আবার বললাম,
‘তুই জানিস না। আজকে কিন্তু ভুতো এবং তুই দুজনেই খেলেছিস, এবং দুর্দান্ত খেলেছিস। ভুতো একাই পাঁচটা গোল দিয়েছে, আর তুই একটা। আমি তিনটে গোল দিয়েছি, তিনটে গোলই হয়ছে তোর বাড়ানো নিখুঁত পাস থেকে। আজ আমরা আলোক সংঘকে ১১-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন। আর সেটার জন্যে ৭০ ভাগ কৃতিত্ব তোদের দুজনার – তুই আর ভুতো!’
কাকিমা আর পিল্লে আমার কথা শুনে অনেকক্ষণ কিছু বললেন না, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে, কাকিমা বললেন,
‘ওরা কারা? কালকে কে এসে আমার পিল্লের পা মচকে দিল? ভুতোকে পচা ঘুগ্নি কে খাওয়ালো, নানু? আজকে তোদের ফাইন্যাল ম্যাচে কারা এসে খেলে গেল, ওদের হয়ে?’
আমি বোধ হয় বুঝতে পারছি। ওরা কারা? কিন্তু কাকিমাকে বললে ভয় পেয়ে যাবেন। ভয় পাওয়ারই তো কথা, ভয় পাবেন না! আমি অন্যমনস্ক ভাবে বললাম,
‘পিল্লে, তোর প্রাইজের এই কাপটা রাখ। এটা তোর পাওনা। আর তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ, আমাদের অনেক কাজ আছে। বিশ্বাস কর, আমি কাল বিকেলে আসিনি এবং তোকে জাম গাছে উঠিয়ে ঠেলে ফেলেও দিই নি। এসব তেঁনাদের কাজ!’ কাকিমা আতঙ্কের স্বরে বললেন, ‘ওরা কারা, কানু’?
পিল্লের ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে আমি গভীর চিন্তার সুরে বললাম,
‘কাকিমা, ওরা নয় ওঁরা। কারা নয়, তাঁরা’। কাকিমা বললেন,
‘দাঁড়া দাঁড়া, কি আজে বাজে বকছিস, কিছুই বুঝলাম না। ওঁরা তাঁরা মানে?’
সদর দরজা দিয়ে বেরোতে বেরোতে আমি বললাম,
‘কাকিমা, ওঁরাই তাঁরা’। তারপর আমি আর দাঁড়ালাম না।



আগেই বলেছি, পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে, আমাদের ক্লাবে হুলুস্থূল কাণ্ড বেশ কটা দিন যেন উৎসবের মতো কেটে গেল। ফাইন্যালের দিন পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে মিষ্টির প্যাকেট বিলি করা হল ক্লাব থেকে, সে কথা তো আগেই বলেছিতারপর শনিবার দিন রাতে বরুণ সংঘের ক্লাবঘরে সবাই মিলে পিকনিক হল – মেনু ছিল পরোটা, বেগুন ভাজা, মাটন কষা, টোম্যাটো-খেজুর-আমসত্ত্ব দিয়ে চাটনি, পাঁপড়। আর শেষ পাতে ক্ষিদ্দার কলকাতা থেকে আনা তালশাঁস সন্দেশ।  ক্ষিদদা, মানে ক্ষিতিশদা কলকাতায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে। এই পিকনিকে এবার রানার্স দল পোড়ামাতলা আলোক সংঘেরও সকলকে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। সমবেত সবাইকে সম্বোধন করে ভোলাজেঠু বললেন, “খেলায় হারজিত আছে, থাকবেই। আর সেইজন্যেই খেলা মানেই মজা। কে জিতল কে হারল, সেটা বড়ো কথা নয়, আমাদের মধ্যে খেলার স্পিরিটটা যেন অবিচল থাকে। সারা জীবন, সকল ক্ষেত্রে”।
এই সব আনন্দের উদযাপন শেষ হয়ে গেলে রবিবারদিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ, আমাদের ফুটবল দলের সবাই জড়ো হলাম বরুণ সংঘের মাঠে। ফাইন্যাল খেলার আগের দিন বিকেলে আমি নাকি ভুতোকে ডেকে নিয়ে পচা ঘুগ্নি খাইয়েছিলাম। আর পিল্লের বাড়ি গিয়ে ওকে জাম গাছে জাম পাড়তে উঠিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম। যার ফল হয়েছিল মারাত্মক। ভুতোর পেট খারাপ হয়ে জেরবার, ফাইন্যাল খেলায় মাঠে আসতেই পারে নি। আর পা মচকে পিল্লেও পায়ে চূণহলুদ লাগিয়ে সারা দিন শুয়েছিল, সেও মাঠে আসতে পারে নি। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার হল, খেলার মাঠে ওরা দুজনেই পুরো সময় খেলেছে, এবং অস্বাভাবিক ভালো খেলেছে। না, না, ওরা এমনিতেও ভালই খেলে, কিন্তু সেদিন বাড়াবাড়ি রকমের ভালো খেলেছিল!
আমাদের এখন ভাবনা হচ্ছে, এই দুজন কারা? যারা আমি হয়ে ভুতো আর পিল্লেকে ভোগান্তি দিল, আর তারপর ভুতো আর পিল্লে হয়ে মাঠে দারুণ খেলল! এই ঘটনার কথা আমরা জানি, আর জানেন পিল্লের মা, আমাদের কাকিমা। অন্য আর কেউ জানে না, এখনো পর্যন্ত কাউকেই বলিনি। এই কথা পাঁচকান হলে আমাদের এবং আমাদের ক্লাবের বেইজ্জতির আর সীমা থাকবে না।
আমার মুখ থেকে সব শুনে, আমাদের দলের বাকি সবাই, প্রচণ্ড অবাক হল। কেউ কিছু বলল না, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে, আমি বললাম,
‘কি রে, তোদের কী মনে হচ্ছে, এ সব শুনে’? সেন্টু খুব নিশ্চিত সুরে, চটপট বলল,
‘মনে হওয়ার তো কিছু নেই, এ তো জলের মতো পরিষ্কার। দুজনের কেউই সাধারণ দেহধারী মানুষ নন, অশরীরি’।
‘অশরীরি, তার মানে ভূ -’ ভিতু টাইপের ভুতো, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সেন্টু থামিয়ে দিল, বলল,
‘ছিঃ ভুতো, আমরা আর বাচ্চাটি নই। তার ওপর আমরা পোড়ামাতলার পরপর তিনবারের চ্যাম্পিয়ন। আমাদের ইয়ে, মানে ওই, যেমন অন্ধকে কানা, খঞ্জকে খোঁড়া এসব যেমন বলা উচিৎ নয়, তেমনি অশরীরিকে ঐ বিচ্ছিরি নামে ডাকাও ঠিক নয়’। ভিতু ভুতো ঢোঁক গিলে বলল,
‘তাই বুঝি? বললে রাগ করেন? দুঃখ পান?’
‘একশ’ বার, পাবেন না? আমার পিসেমশাইয়ের একজন ব্যাচিলার বন্ধু -’।
সেন্টুর কথা কেটে ভুতো জিগ্যেস করল,
‘তিনিও অশরীরি?’ সেন্টু হো হো হো হো করে হেসে বলল,
‘ধূর পাগল, অশরীরি হবেন কেন, তিনি অশরীরি বিশারদ। ওঁনাদের নিয়ে ওঁনার প্রচুর পড়াশুনো। গবেষণাও করেছেন বিস্তর। উনি নিজেও অনেক বই লিখেছেন ওঁনাদের নিয়ে। সে সব বই নাকি, বিদেশে খুব প্রশংসা পেয়েছে’। এই কথা শুনে আমি বললাম,
‘ভালোই হল, তাহলে তোর পিসতুতো কাকাকে ব্যাপারটা বলে দেখ না, উনি যদি কোনো সমাধান দিতে পারেন’।
‘উঁহু। আগে আমি ওঁনাদের সঙ্গে কথা বলবো, নিশ্চিত হবো। ওঁনারা কেমন অশরীরি জানবো, তারপর আমি কাকার সঙ্গে কথা বলতে পারি’।  আমি খুব অবাক হলামসেন্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ওঁনাদের সঙ্গে তুই কথা বলবি, মানে? কোথায় কথা বলবি? কিভাবে কথা বলবি? ওঁনারা কোথায় থাকেন, তুই জানিস নাকি?’
সেন্টু কোন কথা বলল না, আঙুল তুলে দেখাল, আমাদের পিছনের হাজরাচৌধুরিদের পোড়ো বাড়িটা। তারপর বলল,
‘আমার সঙ্গে কে কে যেতে রাজি আছিস বল, আমি আজই যেতে চাই, এখনই’।
‘এখনই’? পিল্লে জিগ্যেস করল, তারপর বলল, ‘গেলে অবিশ্যি এখনই যাওয়া ভালো, এখন দশটা পনের বাজছে, হাতে ঘন্টা দু’ আড়াই সময় পাওয়া যাবে। আর তাছাড়া, ওঁনাদের সঙ্গে দেখা করার এইটাই বোধ হয় সবচেয়ে নিরাপদ সময়। আমি যেতে রাজি আছি। তবে এই সময় ওঁনারা দেখা দেবেন কি? শুনেছি তেঁনারা, রাত বারোটার পর অমাবস্যার রাতে দেখা দিতে ভালোবাসেন’। পিল্লের এই কথায় সেন্টু হাসল, বলল,
‘ওসব একদম বানানো গল্প। আগেকার দিনে ডাকাবুকো লোকেরা, ভিতুদের ভয় পাওয়ানোর জন্যে ওসব লিখতেন বা বানাতেন।  খোনা খোনা নাকি সুরে কথা বলা। হিঁ হিঁ করে হাসা। ঘাড় মটকে রক্ত খাওয়ালকলকে জিভ, চকচকে চোখ, নিজের মুণ্ডু হাতে নিয়ে লোফালুফি খেলা, ওসব একদম অবান্তর গল্পকথা। ওরকম কিছুই করেন না, ওঁরা। তাই যদি করতেন, ওঁনারা নানুর চেহারা নিয়ে ভুতোকে বিকেলবেলা ঘুগনি খাওয়াতে পারেন? তোকে নিয়ে জামগাছে উঠতে পারেন? ওঁনারা বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলতে পারেন!’
সেন্টু অশরীরি বা ভূতের হয়ে যতই ওকালতি করুক, ভয় যে পাচ্ছিলাম না তা নয়, কিন্তু দলের ক্যাপটেন হিসেবে আমার ভয় পাওয়াটা মোটেও ভাল দেখায় না আমি অনেক ভেবেচিন্তে, সাহস করে বলেই ফেললাম,
‘আমি তোর সঙ্গে আছি, সেন্টু’। সেন্টু বলল,
‘বাঃ খুব ভালো হল। পিল্লে, নানু আর আমি, আরেকজন হলে ভালো হতো’। কাতু এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল, কিছু বলেনি, এখন বলল,
‘আমিও যাবো’। কাতুর পিঠে গুঁতো দিয়ে সেন্টু বলল,
‘বাঃ, এই তো চারজন হয়ে গেল। বাকি রইলি তোরা পাঁচজন। যদি খুব অসুবিধে না হয়, আমরা না ফেরা পর্যন্ত তোরা এইখানেই থাক, বসে গল্প-সল্প কর। আমরা যদি সাড়েবারোটা - একটা অব্দি না ফিরি, সব কথা জানিয়ে, ক্লাবে খবর দিস’।
সেন্টু উঠে দাঁড়াতে আমরাও উঠলাম। চোখ চলে গেল উঁচু পাঁচিলের ওপারে পোড়ো বাড়িটার দিকে। বুকের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করে উঠল। সেন্টু যাই বলুক, অশরীরি বলি, আর ভুতই বলি, আমরা যাচ্ছি তো ভুতের ডেরাতেই, তাদের খপ্পরে ধরা দিতেই! কে জানে কি অপেক্ষা করে আছে, আমাদের কপালে!




মরচে ধরা লোহার বিশাল গেটটার একদিক ভাঙা। সেটার ফাঁক দিয়ে এর আগেও বেশ কয়েকবার আমরা বাড়িটার কম্পাউণ্ডে ঢুকেছি; খেলতে গিয়ে বল ঢুকে গেলে, সেটাকে উদ্ধারের জন্যে। সে সময় আমাদের লক্ষ্য থাকত, বলটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করা, আর এই বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে পড়া। কৌতুহল নিয়ে কোনদিনই এই বাড়িটার এদিক সেদিক তেমন লক্ষ্য করিনি। আজ করতে হবে। সেন্টুর যা মতলব, মনে হয় ওই বাড়ির ভিতরেও ঢুকতে হবে!
গেট দিয়ে ঢুকে মুরাম বিছানো পথ চলে গেছে বাড়ির সামনের গাড়ি বারান্দার দিকেযদিও সেই রাস্তার বুকে যেখানে সেখানে ঝোপঝাড় আর ঘাসফুল গজিয়ে, রাস্তাটার অনেকখানিই, রাস্তা বলে আর চেনা যায় না। ডানদিকে বাড়ির পিছনের দিকে যাওয়ার জন্যে ইঁট বিছানো পায়ে চলার রাস্তা ছিল, এখনও রয়েছে, তবে সেও ভেঙে চুরে খারাপ অবস্থাপায়ে চলা রাস্তাটা ধরে সেন্টু এগিয়ে গেল, বলল,
‘বাড়িতে ঢোকার আগে, বাড়ির বাইরেটা একবার ঘুরে দেখে নিই চ’।
ইঁট বিছানো রাস্তার অনেক জায়গাই ভেঙেচুরে গর্ত হয়ে গেছে, তাই দেখে সেন্টু বলল,
‘পুরোনো ইঁটের এই সব খানা খন্দের মধ্যেই, সাপের বাসা থাকে, সাবধানে দেখে চলিস’
আমরা সাবধানেই হাঁটছিলাম, সেন্টুর কথায় আরো সতর্ক হলাম। আমাদের বাঁদিকে বাড়ির ইটের দেওয়াল ফাটিয়ে অনেক জায়গাতেই বট আর অশ্বত্থের চারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দু একদিনের বৃষ্টিতে, তাদের চকচকে সবুজ পাতা, সকালের হাল্কা হাওয়ায় দুলছে। আর ডানদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে অনেক রকমের গাছ। তার মধ্যে আম আছে, গোটা চারেক। পেয়ারা গোটা তিনেক। আরো দু চারটে গাছ আছে, একটা মনে হল সবেদা। কোনদিন হয়তো এই জায়গাগুলো পরিচ্ছন্ন বাগান ছিল, এখন বড়ো বড়ো গাছের নিচে ঘন ঝোপঝাড়ে আগাছার জঙ্গল হয়ে উঠেছে। মাকড়সার ঘনজাল ছেয়ে আছে অনেক জায়গায়। বোঝা যায়, বহুদিন এই সব জায়গায় কোন মানুষ ঢোকে নি। কাতু বলল,
‘বাপরে, কি অবস্থা রে, এই সব ঝোপঝাড় থেকে বাঘ না বের হোক, দু একটা শেয়াল বেরোলেও আশ্চর্য হবো না’।
বাড়ির পিছন দিকে একটা বিশাল পাড় বাঁধানো কুয়ো, তার পাশে একটা ছোট্ট কুঠুরি ছিল, এখন ভাঙা চোরা ইঁটের স্তূপ। কুয়োর মধ্যে উঁকি মেরে দেখলাম, সেটা শুকনোমাটি আর রাবিশে ভরে উঠেছে, গজিয়ে উঠেছে নানান আগাছার জঙ্গল। এদিকটায় অনেকগুলো ব্যারাকধরনের ঘরও ছিল, এখন সবই ধ্বংসস্তূপ। এই বাড়ির কাজের লোকজনেরা হয়তো এই সব ঘরেই থাকত। এখন সব ইতিহাস। পিছনদিক ঘুরে আমরা বাড়ির অন্যপাশে চলে এসেছি। বাড়ির এদিকটার অবস্থা অনেকটাই ভালোদেয়াল ফাটিয়ে গাছপালা তেমন কিছুই নেই। ঘরদোরগুলো আস্ত আছে বলেই মনে হয়। যদিও রাস্তার ডানদিকে অনেক খানি জায়গা জুড়ে ঘন ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। মনে হল, সে সময় ওদিকে মানে বাড়ির ডানদিকে ছিল ফলের বাগান, আর এদিকটায় ছিল ফুলের বাগান। সেই জন্যে এদিকে কোন বড়ো গাছ নেই। আর ফুলের গাছটাছ যা ছিল, সে সব আগাছার আক্রমণে বহুদিন অশরীরি হয়ে গেছে! আমার তাই মনে হল, কারণ গাছের যখন প্রাণ আছে, তখন তাদেরও অশরীরি হতে তো কোন বাধা নেই, তাই না?
তিনদিক ঘুরে এসে আমরা এসে দাঁড়ালাম এবার বাড়ির সামনে, গাড়িবারান্দার নিচে। গাড়িবারান্দার ছাদ ভেঙে গেছে কবেই। পাশের থাম আর দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। চার ধাপ সিঁড়ির পর বাড়ির সদর দরজা, পাল্লা আর নেইদরজার পাল্লা নিশ্চয়ই চোরে চুরি করে নিয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে আমরা আস্তে আস্তে ঢুকলাম। আমি আর সেন্টু সামনে, পিছনে পিল্লে আর কাতু। প্যাসেজ পেরিয়ে একটা বিশাল হলঘরএকদম ফাঁকা। মেঝেয় পুরু ধুলোর আস্তর, দেওয়ালে মাকড়সার জাল। কোন জানালার কোন পাল্লা নেই, বৃষ্টি হলে ঘরের ভেতর ঝাপটা আসে। দেওয়ালে, মেঝেয় জলের ময়লা ছোপ। তার ওপর কেমন যেন বিচ্ছিরি বোঁটকা মতো গন্ধ! একদম ফাঁকা নোংরা বিশাল হলঘরে ঢুকে মনের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি হতে শুরু হল।  কাতু খুব চাপা স্বরে বলল,
‘সেন্টু, নানু। আমার মনে হয়, আর যাওয়ার দরকার নেই। তেঁনারা কেউ থাকলে, এতক্ষণে দেখা পাওয়া যেত’
কাতুর এই চাপা স্বরের কথাও, সেই মস্ত ফাঁকা হলঘরে গমগম করে উঠল। আমি ঠোঁটে আঙুল দেখিয়ে ইশারা করলাম - কথা বলিস না। হলঘর থেকে দুপাশেই লম্বা করিডর চলে গেছে।  করিডর ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম, বাঁদিকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি, তারপর তিন-তিন ছটা ঘর, দুপাশে। বড়ো বড়ো ঘর, হা হা করা ফাঁকা, ধুলোর পরতে মোড়া। দুর্গন্ধ, ছাগলের নাদি, ঝুল, মাকড়সার জাল, দেওয়ালের ছোপ। এদিকে আবার বেশ কয়েকটা দেওয়ালে ফাটল, ফাটলের মধ্যে আঁকড়ে ধরে আছে গাছের শেকড়। বেশ গা ছমছমে ব্যাপার।
একতলা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম সিঁড়ির মুখে, ওপরে তাকিয়ে মনে হল, যতো রহস্য দোতলায় কিংবা তেতলায়। নয়তো বা ছাদের ঘরে। সেন্টু উঠে গেছে, আমিও উঠতে যাবো, কাতু আমার হাত ধরে টানল, ইশারায় বলল, চ, ফিরে যাই। কি হবে? কিছুই তো নেই। আমি কাতুর কথায় কান দিলাম না। সিঁড়িতে পা দিলাম। কাতু আর পিল্লে নিচেয় দাঁড়িয়ে রইল প্রথম ধাপে পা রেখে। ততক্ষণে আমরা প্রথম ল্যান্ডিংয়ে উঠে গেছি, বাঁদিকে মোড় নিয়ে দ্বিতীয় সিঁড়িতে ওঠার আগে ইশারায় কাতু আর পিল্লেকে বললাম, আয়। ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে, নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। আমরা দুজন আর দাঁড়ালাম না, উঠতে লাগলাম
সিঁড়ির প্রথম ল্যান্ডিংয়ের জানালার জং ধরা লোহার ফ্রেমটা এখনো রয়ে গেছে। এই ফ্রেমে কোনদিন কাচ ছিল, এখন একটাও নেই। আমি সিঁড়ি উঠতে উঠতে ওপরের দিকে তাকালাম। ওপরের সিঁড়ির খাঁজে এক ঝাঁক চামচিকে ঝুলছে, নিচের দিকে মুন্ডু আর উপরের দিকে পা। নাকে এসে লাগল বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ। দোতলায় উঠে আবার নিচের দিকে তাকালাম, কাতু আর পিল্লে উঠলো কিনা দেখার জন্যেদেখতে গিয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল। আমি সেন্টুর হাত ধরে টানলাম। সেন্টু আমার দিকে ফিরে তাকাতেই, সিঁড়ির ব্যাপারটা তারও নজরে এল। সেন্টুর মুখটা ভয়ে আর বিস্ময়ে ফ্যাকাসে হয়ে উঠল।


আমি আর সেন্টু কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিঁড়ির ঝাপসা হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে যখন ভাবছি কি করা যায়, ঠিক তখনই শুনলাম,
‘ভয় পাস না, বাবা। কোন ভয় নেই’। পরিষ্কার এই কথা শুনে আমরা আরো ভড়কে গেলাম। ঘাড়ের চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠল। চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। ভয়ে আমাদের পা কাঁপতে লাগল।
‘ঘাবড়াস না, বাপ, ঘাবড়াস নাতোদের কোন ক্ষতি হবে না, আয়, আমার সঙ্গে এদিকে আয়। সিঁড়িতে আমাদের কানাই ধুলো ওড়াচ্ছে। বহুদিনের জমাট ধুলো তো, তাই আধো আলো অন্ধকারে সিঁড়িটা মনে হচ্ছে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। তা নয় রে, তা নয়। আয় ওপরে আয়’।
কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না, অথচ কেউ একজন অনর্গল উপদেশ দিয়ে চলেছে। ভয়ে আমাদের জিভ, তালু, গলা শুকিয়ে কাঠ।
‘ভয়টা কমা। বার বার বলছি না, ভয় নেই! সবাই মিলে কামড়ে দেবো, মিথ্যে অমন ভয় পেলে। হে হে হে হে, মনে আছে, সুকুমার রায়ের সেই ছড়াটা? ভয় পাস না, ভয় না কমলে আমাদের দেখা পাবি না’
ভুতের থুড়ি, মানে অশরীরির মুখে রামনাম কেউ শুনেছে কি না জানিনা, কিন্তু অশরীরির মুখে সুকুমার রায়ের ছড়া শুনে আমরা দুজনেই অত ভয়ের মধ্যেও একটু যেন ভরসা পেলাম। আজ পর্যন্ত যত ভুতের গল্প পড়েছি বা শুনেছি কস্মিনকালে, কোন ভুত সুকুমার রায়ের ছড়া বলে, এমন শুনিনি। আমি সেন্টুর মুখের দিকে তাকালাম। ওর মুখে ফ্যাকাসে হাসি। আমিও খুব চেষ্টা করলাম হাসবার। ভাবখানা আমরা ভয় পাচ্ছি না।
‘বাঃ, বেশ। এই তো মুখে হাসি ফুটছে। যদিও হাসিটা পাতলা মেঘের আড়ালে চাঁদের মতো উড়োখুড়ো ফ্যাকাসে। তা হোক, হাসি তো! এবার এই ওপরের দিকে তাকা। এই যে রে ছাদের সিঁড়ির ওপরে’।   
আমরা তিনতলার ছাদে ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের দিকে তাকালাম। প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর মনে হল, ঝাপসা মতো কিছু একটা যেন ভাসছে। অল্প হাওয়াতে ভারি পর্দায় যেমন হাল্কা হাল্কা দুলুনি হয়, অনেকটা সেরকম।  ঝাপসা মতো ব্যাপারটা এবার বলল,
‘দেখতে পাচ্ছিস তো’?
আমরা দুজনেই ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম, মুখ দিয়ে শব্দ বের করার মতো অবস্থা তখনো হয় নি।
‘আয়, ওপরে আয়। ছাদে বসে আমরা আলাপ আলোচনা করবো। নিচেয় এখন ধুলোয় পুরো ভরে যাবে। আমরা অশরীরি, আমাদের কিচু হবে না। তোদের তো অব্যেস নেই, অ্যালার্জি হবে, কাশি হবে, হাঁচি হবে। ভয় করিস না, চটপট চলে আয়’।
ঝাপসা ব্যাপারটার কথার মধ্যে বেশ একটা আন্তরিক ভাব। আমার মনে হল, এঁনাদের যদি কিছু ক্ষতি করার মতলব থাকতো, কবেই করে ফেলতে পারত। এতক্ষণ আমরা হয়তো ঘাড় মটকে সিঁড়ির রেলিংয়ে লটকাতাম। তেমন কিছু হয় নি যখন, দেখাই যাক না শেষ অব্দি। সেন্টু আমার মুখের দিকে তাকাতে, আমি ইশারায় বললাম, চল।
আমাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে ঝাপসা ব্যাপারটা, ওপরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। আমাদের মন থেকে ভয়টা এখন অনেকটাই কমে যাওয়াতে, ঝাপসার অবয়ব ফুটে উঠতে লাগল। একটু অস্পষ্ট, কিন্তু হাত-পা, মাথা, ধুতি আর ফতুয়া পড়া শরীরটা বোঝা যাচ্ছিল।
ছাদে উঠে, খোলা হাওয়ায় আর সূর্যের আলোয় আমাদের মনের ভয়টা একদমই চলে গেল। আমরা ভদ্রলোককে মোটামুটি ভালই দেখতে পেলামগোলগাল চেহারা, মাথায় টাক। সব মিলিয়ে বেশ অমায়িক চেহারা। আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন, সে হাসিতে কোন বদ মতলব আছে এমনটা তো মনে হল না। ছাদের চিলেকোঠা ঘরের মধ্যে ঢোকার আগে, তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন, বললেন,
‘কি রে, আর ভয় করছে না তো? আর ভাল করে লক্ষ্য করে দ্যাখ, তোদের পায়ের তলায় রোদ্দুরের ছায়া পড়েছে, আমার পায়ের তলায়...?’
‘ছায়া নেই’। আমি অবাক হয়ে উত্তর দিলাম।
‘তার মানে কি বলতো?’ কঠিন ধাঁধা ধরার মতো, উনি জিগ্যেস করলেন।
‘আপনি অশরীরি’। সেন্টু চট করে উত্তর দিল ভাগ্যিস, আমি হয়তো ফস করে ভুতই বলে ফেলতাম।
‘ঠিক। তুই যে ভুত বলিস নি, তাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আয় ঘরে এসে বসি, আমাদের আবার বেশিক্ষণ রোদ্দুর সহ্য হয় না। বেশি আলোতে থাকলে আমরা ঝাপসা হয়ে যাই’
অশরীরি ভদ্রলোকের পিছনে পিছনে আমরা দুজন ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। রোদ্দুর থেকে ঘরে ঢুকে প্রথমে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। বেশ অন্ধকার। একটু পরে চোখ সয়ে যেতে যা দেখলাম, এ বাড়ির পক্ষে বেশ বেমানান লাগলো।  এ ঘরটাও বেশ বড়ো সড়ো। একটু এলোমেলো হলেও, অনেক আসবাবপত্র আছে। ঘরের মেঝেটাও বেশ পরিষ্কার, ধুলো-টুলো নেই। দুখানা জানালা আছে, আমরা যে দরজা দিয়ে ঢুকলাম, সেই দরজাতে কাঠের পাল্লাও আছে। ঘরের জানালাগুলো অবশ্য চেপে বন্ধ করা বলে, ঘরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার। পাঁচখানা বেতের চেয়ার রয়েছে। কোণের দিকে দুটো বড়ো কাঠের সিন্দুক। তালা দেওয়া নেই, ভারি ডালা বন্ধ করা আছে শুধু। তাছাড়া একটা দেয়াল আলমারি আছে, সেটায় কাচের পাল্লা সব ঠিকঠাক, তকতকে পরিষ্কার আলমারিটার দিকে চোখ পড়তেই, আমি আবার চমকে উঠলাম। পাশাপাশি দুটো কাপ, আর একটা বইয়ের ছোট প্যাকেট। এগুলো আমি নিজে হাতে ভুতো আর পিল্লেকে দিয়ে এসেছিলাম এগুলো এখানে এলো কি করে? আমি অশরীরি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম।
অন্ধকার ঘরে এবার অশরীরি ভদ্রলোককে আরো একটু স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তিনি আমাদের দিকেই দেখছিলেন। তাঁর মুখে এখন মিটিমিটি হাসি,
‘কি রে, আর ভয় করছে না তো? চেয়ার টেনে বোস’। নিজে একটা চেয়ার টেনে বসলেন, তাঁর দেখাদেখি আমরাও দুজনে দুটো চেয়ারে বসলাম। আমরা বসার পর অশরীরি ভদ্রলোক বললেন,
‘আলমারিতে কাপ দুটো আর ওই বইয়ের প্যাকেট দেখে আবার ঘাবড়ে গেলি তো? ঘাবড়াস নাসব বলছি। সব বলব বলেই তোদের দুটিকে ওপরে নিয়ে এলাম। বাকি দুটিকে আসতে দিলাম না। ওদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা পালিয়ে এলাম, কি বল?’ অশরীরি ভদ্রলোক নিজের মনেই হে হে হে হে করে একটু হাসলেন। তারপর আবার বললেন, ‘সবাইকে সব কথা খুলে বলা যায় না, জানিস তো? আধার বুঝিস, আধার’?
‘আধার কার্ড?’ আমি জিগ্যেস করলাম। আমার কথার পিঠে সেন্টু বলল,
‘না রে, আঁধার, মানে অন্ধকার’আমার দিকে চোখের ইশারা করে সেন্টু আবার বলল, ‘চন্দ্রবিন্দুটা হারিয়ে গেছে’।
‘ধুর ধুর, তোরা কিস্‌সু জানিস না। আধার মানে পাত্র’। অশরীরি ভদ্রলোক বললেন।
‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। পাত্রাধার তৈল, নাকি তৈলাধার পাত্র’, আমি বলে উঠলাম, ‘শুনেছি, শুনেছি’।
‘অ্যাই, এতক্ষণে ভয় পুরোপুরি কেটে, তোদের মগজ ঠিকঠাক কাজ করছে। তাই না রে? ঠিক বলেছিস। এই যেমন ধর, আমরা যখন দুধ খাই, সেকি থালায় ঢেলে খাই? খাই না, গেলাসে বা বাটিতে করে খাই। আবার, যখন জল খাই তখন কি গামলা কিংবা ডেকচিতে খাই? খাই না, গেলাসে খাই আমাদের সময়ে ঘটিতেও খেত, তোরা আজকাল বোতলে খাস তোরা দুজন বেশ ভালো আধারআমি এখন যে কথাগুলো বলব, সেগুলো পাঁচকান করার জন্যে নয়।  তোদের বললে কথাগুলো তোদের মধ্যেই রেখে দিবি, ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়াবি না তোদের সঙ্গী আর যে দুটো ছিল, ও দুটো হালকা আর ফঙ্গবেনে, পেটে কথা রাখতে পারবে না। বদহজম হয়ে যাবে। সেই ভবম হাজামকে মনে আছে? “রাজার দুই শিং, রাজার দুই শিং! কে বলেছে, কে বলেছে? ভবম হাজাম, ভবম হাজাম”। সেই রকম আর কি!’
অশরীরি ভদ্রলোক এই কথা বলে হো হো করে হেসে উঠলেন, আমি আর সেন্টুও হাসলাম। ছোট বেলায় পড়েছিলাম, মনে পড়ল। আমার কিন্তু অশরীরি ভদ্রলোককে বেশ লাগছে। বেশ মজার দাদু টাইপের। অশরীরি ভদ্রলোককে দাদু বললে রেগে যাবেন নাকি? আমি হাসতে হাসতে বলেই ফেললাম,
‘মনে আছে, দাদু’। অশরীরি ভদ্রলোক আচমকা হাসি থামিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। আমি আবার ভয় পেতে শুরু করলাম। একটু পরে, আবার হাসতে লাগলেন, আগের মতো। তারপর হাসির দমক একটু কমলে বললেন,
‘দাদু। খুব ভালো বলেছিস। দাদু। নানু, আমি যখন বরুণ সংঘের সভাপতি ছিলাম, তোর বাবা, হারু - শ্রীমান অরবিন্দ সরখেল তখন সবে ক্লাস ফাইভে উঠেছেআর সেন্টুর বাবা, নিতু – শ্রীমান নিত্যানন্দ তালুকদার একটু বড়ো, সিক্স কি সেভেনে পড়ত। আমি কে, জানিস না তো’?
অশরীরি দাদু, আমাদের দুজনেরই বাবার নাম জানেন দেখে আমরা বেশ অবাক হলাম, আমরা ঘাড় নেড়ে বললাম, না। মুচকি হেসে অশরীরি দাদু বললেন,
‘তোরা এইবার যে কাপটা জিতে বরুণ সংঘকে পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন করলি, সেই কাপটা আমার মায়ের নামে আমিই দিয়েছিলাম, বুঝলি?’।
‘আপনি তার মানে, মেজদা? স্বর্গীয় রজনীকান্ত হাজরাচৌধুরী?’ আমাদের এই কথায় অশরীরি দাদু আবার হেসে উঠলেন হো হো করে, তারপর বললেন,
‘ধুর পাগল, তোদের বাবারা ‘মেজদা’ বলতো বলে, তোরাও তাই বলবি নাকি রে, হতচ্ছাড়া, অ্যাঁ?’ আবার বেশ খানিকক্ষণ হাসলেন, তারপর বললেন,
‘না, না, দাদুই ভালো, তোরা দাদুই বলিস। দাঁড়া, আমার দুই নাতির সঙ্গে তোদের পরিচয় করিয়ে দিই, একদম তোদেরই বয়সী, যমজ তখন ওরাও নাইনে পড়ত। লাট্টু আর লেত্তি। ভাল নাম অবনীকান্ত আর নবনীকান্ত। তোদের বাবা, হারু আর নিত্যকে বললে চিনবে কিন্তু বলতে যাস না, যেন। যদি জানতে পারে আমার সঙ্গে তোদের ভাব হয়েছে, তোদের মায়েরা তোদের আর এখানে আসতেও দেবে না, এমনকি ওই মাঠে খেলতেও দেবে না। উল্টে ভুতপ্রেতের সঙ্গে গল্প করেছিস বলে, তান্ত্রিক ডেকে ঝাড়ফুঁক করাবে। তখন বুঝবি, ঠ্যালা কাকে বলে! আসল ভূতের আক্রমণের থেকেও, ওঝাদের চিকিৎসার ভড়ং অনেক বেশি ভয়ংকর হয়,’ অশরীরি দাদু আবার হেসে উঠলেন হা হা করে। একটু পরে হাসি থামিয়ে বললেন, ‘দাঁড়া ওদেরকে ডাকি’।


চেয়ার থেকে উঠে অশরীরি দাদু, দরজাটা অল্প ফাঁক করে, ঠোঁট সরু করে ডেকে উঠলেন। অবিকল পাখির ডাক। একবার ডাকলেন, দুবার ডাকলেন। তারপর বাইরে দূর থেকে সেই ডাকের আমরা সাড়াও পেলাম। অশরীরি দাদু ফিরে চেয়ারে বসে, মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে, বললেন,
‘মর্কটদুটো আসছে। ওরা তোদেরই বয়সী, আর তোদের মতোই খেলাধুলোয় খুব ভালো’।
কথা শেষ হতে না হতে, ঘরের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল। আমরা তো আঁতকে উঠেছিলাম। চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রথমে কাউকেই দেখতে পেলাম না। দরজার বাইরে রোদে উজ্জ্বল ছাদ, ছাদের পাঁচিল আর নীল আকাশ দেখতে পেলাম।  তারপর দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যেতে, ঘরটা আবার অন্ধকার হয়ে গেল, আমরা দুটো ছেলের অবয়ব দেখতে পেলাম। সত্যিই আমাদের বয়সীই মনে হল। আমরা ভয়ে ভয়ে অশরীরি দাদুর দিকে তাকালাম। তাঁর চোখে এখন ভ্রুকুটি মাখা বিরক্তি, বললেন,
‘পিটিয়ে তোমাদের তক্তা বানিয়ে দেব, বুঝেছ? কতবার বলেছি, ওভাবে দরজা খুলবি না! তাছাড়া তোরা জানিস, আমার সঙ্গে দুজন মানুষ রয়েছে, তারা তোদের মতো হাওয়া নয়’।
আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকালাম। এখন অনেকটাই স্পষ্ট। কাঁচুমাচু মুখে মাথা চুলকোচ্ছে। অশরীরি দাদু কিছুক্ষণ ওদের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমাদের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে বললেন,
‘এই যে আমার দুই নাতি লাট্টু আর লেত্তি। বাঁদিকেরটা লাট্টু আর ডানদিকেরটা লেত্তি। যমজ তো, একইরকম দেখতে, প্রথম প্রথম তোরা আলাদা করতে পারবি না। এদিকে এসে চেয়ারে বোস, পাজিদুটো’। শেষের কথাটা লাট্টু আর লেত্তিকে বললেন। ওরা দুজনে এসে আমাদের সামনের চেয়ারে বসল। এবারে ওদের বেশ স্পষ্টই দেখতে পেলাম। অশরীরি দাদু বললেন,
‘আমার নাতি হলে কি হবে, দুটোই খুব বিচ্ছু ছেলে। বিকেলে তোরা মাঠে যখন খেলিস, ওরা দুজনে আমাদের পাঁচিলে পা ঝুলিয়ে বসে বসে খেলে দেখে। যেদিন জানলো তোরা ফাইন্যালে উঠেছিস, আর এইবার ফাইন্যাল জিতলে তোরা পর পর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হবি, আমার কাছে এসে বায়না ধরল, ওরা ফাইন্যালে খেলবে। আমি বললাম তা কি করে হবে? তোদের কে কেউ দেখতেও পায় না, চেনেও না, শোনেও না। খেলায় নেবে কেন? তাও এমনি খেলা হলে ঠিক আছে, ফাইন্যাল বলে কথা? তা আমায় বললে, “ও নিয়ে তুমি ভেব না দাদু, সে আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নেব”। আমি বললাম, “পারলে খেল, কিন্তু কোন ছেলেকে ভয় দেখিয়ে খেলেছিস, এ যদি আমি জানতে পারি, তোদের দুজনের পিঠ আমি আস্ত রাখবো না”’  এই কথায় আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
‘দাদু, এই যে আপনি বলছেন, পিটিয়ে তক্তা করে দেবেন, পিঠ আস্ত রাখবেন না। মানে, ইয়ে আমি বলছিলাম অশরীরিদের এমন কি করা যায়?’ আমার কথায় অশরীরি দাদু এবার হো হো করে হেসে উঠলেন, একটু পরে বললেন,
 ‘শরীরই নেই তার আবার তক্তা কি? আমাদের ঝাপসা শরীরে পিঠই নেই, তো ভাঙবো কি? তবে হ্যাঁ, চুলের মুঠি ধরে, গুম গুম করে কিল বসাই। কিন্তু চুলই নেই ধরব কি? ছায়া মুঠি দিয়ে কি আর কিল মারা যায় রে? তবু ওই কথাগুলো বলি, এককালে তো মানুষ ছিলাম, এখন না হয় ছায়া হয়েছি। অব্যেস কি আর ছাড়ে রে?’
অশরীরি দাদুর এই কথায় লাট্টু আর লেত্তি খুঁক খুঁক করে হাসছিল। তাদের হাসির শব্দে অশরীরি দাদু আবার কটমট করে তাকালেন ওদের দিকে। ওরা হাসি থামিয়ে চুপ করে বসে রইল। অশরীরি দাদু আবার বললেন,
‘তারপর তো কি হয়েছে না হয়েছে, আমি জানি না। দুজনে সারাদিন গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছিল, আমি আমল দিই নি। ফুড়ুৎ ফাড়াৎ বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছিল, তাও পাত্তা দিই নি। একেবারে ফাইন্যাল খেলার শেষে বাড়ি এসে খুব নাচানাচি করছিল। তখন জানতে পারলাম, ওরাও খেলেছে। কি করে খেললি জিগ্যেস করতে, যা বলল, তাতে আমারই ভুতে-পাওয়া দশা। এখন তোরাই তোদের কিত্তির কথা বল, নানু আর সেন্টুকে’। শেষের কথাটা লাট্টু আর লেত্তিকে বললেন। তবে অশরীরির মুখে ভুতে পাওয়ার কথা শুনে আমার বেশ হাসিই পেল, কিন্তু হাসলাম না।
লাট্টু আর লেত্তি কে একই রকম দেখতে, সত্যি আলাদা করে চেনা দায়। ওদের মধ্যে একজন বলল,
‘ফাইন্যালের আগের দিন নানুর বাড়ি যখন গেছিলাম, ও দুপুরে নিজের ঘরে বসে পড়া করছিল। ইতিহাস বই না রে? তোর বইতে মনে হচ্ছে যেন, শেরশাহের ছবি দেখেছিলাম। তাই না’? আমি ভীষণ অবাক হয়ে ঘাড় নেড়ে বললাম,
‘হুঁ। ইতিহাস পড়ছিলাম। শের শাহের শাসনব্যবস্থা’।
‘ঠিক ধরেছি। তিরিশ বছর আগে আমরাও মুখস্থ করতাম রে, শের শাহ। এখনো মনে আছে। সে যাক গে, পড়ছিলি না, ছাই! আমি যাওয়ার থেকেই তো ঘুমে ঢুলছিলি, তিনবার টেবিলে রাখা বইয়ে মাথা ঠুকেছিস। শেষ অব্দি সোয়া চারটে নাগাদ টেবিলে মাথা রেখে নানু ঘুমিয়েই পড়ল। আর আমিও এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লাম নানুর শরীরে, আর নানু হয়ে গেলাম। নানুর খোলসের ওপর জামাটা চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ভুতো তখন পাড়ার “খুবমিষ্টি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে” গেছে, বোঁদে আর গুজিয়া কিনতে। ভুতোকে গিয়ে ধরলাম, বললাম,
‘কি রে, মিষ্টি কিনছিস? বাড়ির জন্যে, নাকি নিজে খাবি বলে?’ ব্যাজার মুখ করে ভুতো বলল,
‘বাড়ির জন্যে। মা পাঠালো। তা তুই এখানে কোত্থেকে উদয় হলি?’ আমি বললাম,
‘আমিও বেরিয়েছি ঘুগ্নি খাবো বলে, হারাধনের ঘুগ্নি। চল না খেয়ে আসি, এই তো সামনে’।
ভুতো আমার সঙ্গে চলল, আমি মানে নানুর খোলসপড়া আমি। হারাধনের দোকানে গিয়ে দুটো ঘুগনি কিনলাম, একটা দিলাম ভুতোকে। আরেকটা নিলাম আমি। সারা সকাল থেকে আমি আর লেত্তি অনেক কিছু গাছ-গাছড়া বেঁটে ঘেঁটে, পেটখারাপের গুলি বানিয়েছিলাম। ছোট্ট ছোট্ট সেই গুলির দুটো মিলিয়ে দিলাম ভুতোর ঘুগনিতে। তারপর ঘুগনি খেয়ে, ও গেল বাড়ি, আর আমি চললাম পিল্লের বাড়ি।
পিল্লের বাড়ি গিয়ে দেখি, পিল্লে ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। পিল্লের বাড়ির গাছে এবার খুব জাম হয়েছে, জানতাম বললাম,
‘এই পিল্লে, চল গাছপাকা জাম খাবো’। পিল্লে আমায় বলল,
‘আজ নয় কালকে খাবো। কালকে ফাইন্যাল খেলা আছে, আজ গাছে উঠবো না, বাবা। যদি পড়ে-টড়ে যাই’?
‘তুই কি ভিতু রে? তোদের নিজেদের গাছ, পড়বি কেন? গাছে কি ভুত আছে নাকি?’ আমি বললাম।
‘ভুত? ভুতকে আমি ভয়ও পাই না, বিশ্বাসও করি না’। পিল্লে একেবারে বুক ফুলিয়ে বলল। আমি বললাম,
‘তবে আর কি? তাড়াতাড়ি উঠি চল, সন্ধে হয়ে গেলে, আমার আবার খুব ভয় লাগে!’ ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে পিল্লে আমায় বলল,
‘কিসের ভয় পাস, নানু?’ আমি তাড়া দিয়ে বললাম,
‘সে আর তোর শুনে কাজ নেই, যাবি তো চল। আমি উঠছি’। এই না বলে আমি ছাদ থেকে নেমে ওদের বাড়ির পিছনের জামগাছে চড়তে লাগলাম। পিল্লেও আমার পিছনে এল। কাকিমা, মানে পিল্লের মা, একবার মানা করেছিলেন কে শোনে কার কথা। আমি গাছে উঠে দুটো ডালের খাঁজে বসে হাত বাড়িয়ে পিল্লের একটা হাত ধরে টেনে তুলছিলাম। মাঝামাঝি জায়গায় আমি হাত ছেড়ে দিতেই, পিল্লে হড়কে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ল মাটিতে। “উরি বাবারে, আমার পাটা ভেঙে গেল রে, নানু”! পিল্লের এই চেঁচানি শুনে আর ওদিকে কাকিমার, “কী হল রে? কী হল রে?” করতে করতে দৌড়ে আসার আওয়াজ শুনেই, আমি পালিয়ে গেলাম ওদের বাড়ির পাঁচিল টপকে
লাট্টু কিংবা লেত্তি থামতে, অশরীরি দাদু আমাদের ফিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বুঝেচিস কাণ্ডটা? আমার এই নাতি দুটো যে কি বিচ্ছু, তোদেরকে বলে বোঝাতে পারবো না। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। যদিও আমার আর মাথা কেটেই বা কি হবে! সবই তো ছায়া। থামলি কেন, লাট্টু, বাকিটা বল!’
এতক্ষণ তার মানে লাট্টুই বলছিল, দাদুর কথায় লাট্টু আবার শুরু করল,
‘খেলার আধঘণ্টা আগে, আমি গেলাম ভুতোর বাড়ি আর লেত্তি গেল পিল্লের বাড়ি। দুজনেই তখন বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল। ভুতো পড়ছিল “সোনারকেল্লা”, আর পিল্লে পড়ছিল “সাহারায় শিহরণ”। আমরা গিয়ে ওদের মাথার কাছে বসে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। আমাদের অশরীরি হাতের শীতল ছোঁয়ায় দুজনেই খুব আরাম পাচ্ছিল, আর ওদের চোখ ঘুমে বুজে আসছিল। একসময় দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল। আর ঘুমিয়ে পড়তেই আমি ভুতোর আর লেত্তি পিল্লের খোলসদুটো গায়ে চড়িয়ে নিলাম। ওদের ঘরের আলনায় ঝুলছিল খেলার জার্সি, সেটা গায়ে গলিয়ে নিলাম। ঘরের কোণায় ছিল খেলার বুটজোড়া, সেটাও পরে ফেললাম। তারপর ঘরের দরজা নিঃশব্দে ভেজিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, ওদের বাড়ির পাঁচিল টপকে। সদর দরজাদুটো ভেতর থেকে বন্ধই রইল।
তারপর আর কি, মাঠে এসে তোদের সঙ্গে খেললাম। অনেকদিন পর সেদিন খেলে, দারুণ মজা পেয়েছিলাম। খেলা শেষ হওয়ার পর এক মূহুর্তও আর বিলম্ব না করে কেটে পড়লাম মাঠ থেকে। আমি ভুতোর বাড়ি আর লেত্তি পিল্লের বাড়ি গিয়ে ওদের শরীর যেমন–কে–তেমন আবার ফেরত দিয়ে দিলাম। ফেরত দিলাম জার্সি আর বুটজোড়াও! আমরা আবার অশরীরি হয়ে, আমাদের বাড়ির পাঁচিলে ভুতের মতো পা ঝুলিয়ে বসে বসে দেখতে লাগলাম তোদের পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান’।
এতক্ষণ লেত্তি কিছু বলে নি, চুপ করে শুনছিল, সে বলল,
‘পুরষ্কার বিতরণীর সময়, ভুতোর আর পিল্লের নাম ধরে যখন ডাকছিল, আমি লাট্টুকে বললাম, চল নিয়ে আসি, ওগুলোতো আমাদেরই পাওনা! ভুতো আর পিল্লেতো খেলেই নি, ঘুমোচ্ছিল। খেললাম তো আমরা! আমাদেরই তো ওই প্রাইজগুলো পাওয়ার কথা। লাট্টু আমাকে আটকালো, বলল, ধুর আমরা তো অশরীরি। পুরষ্কার নিতে গেলে সব ব্যাপারটা জানাজনি হয়ে যাবে। মানুষগুলো ভয় পাবে, তখন এই লিগের খেলাই হয়তো চিরকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে। নানু সন্ধে বেলা যখন প্রাইজগুলো ওদের বাড়ি গিয়ে দিয়ে এল, আমার এমন রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, নানুর ব্যাগ থেকে প্রাইজগুলো কেড়ে নিই। তখন নিই নি। পরে অনেক রাত্রে ওদের ঘরের আলমারি থেকে সব প্রাইজগুলো নিয়ে এসেছিলাম। ওরা বোধহয় এখনো জানেও না, যে ওদের ওগুলো খোয়া গেছে’
লাট্টু-লেত্তির কথা শেষ হতে, অশরীরি দাদু ওদের ধমকে উঠে বললেন,
‘নে নে, আর বেশি বাহাদুরি করতে হবে না। তোরা কি বুঝবি, নানুর দল আর ওর বরুণসংঘকে কি বিপদে ফেলেছিস। তোদের কথা কেউ কেউ  আঁচ করতে পেরে গেছে, এখনো সাতকান হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ? হলে, গোটা পোড়ামাতলায় ঢি ঢি পড়ে যাবে, বরুণ সংঘ অশরীরি ভাড়া করে এনে চ্যাম্পিয়ন হয়ছি ছি, ছিঃ। গত দুবার যে নানুরা নিজেরা খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সে কথা কেউ কি আর বিশ্বাস করবে? করবে না। সব্বাই দুয়ো দেবে। সামনের বছরগুলোতে হয়তো বরুণ সংঘকে আর লিগ খেলতেই দেবে না। আমার মায়ের নামে কাপ, অথচ আমাদের ক্লাবকেই বের করে দেবে, উন্নয়ন সমিতি! বুঝতে পারছিস, হতচ্ছাড়া, পাজির পাঝাড়া দুটো! তোদের জন্যে বরুণ সংঘ কি আতান্তরে পড়তে পারে!’
তিনজন অশরীরির সঙ্গে আমরা দুজন মুখ গোমড়া করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। আমাদের মাথায় কিছুই আসছিল না, এর উত্তরে কি বলব! অশরীরি দাদু যা বললেন সে কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। লাট্টু-লেত্তির কথা আমাদের বাড়িতে বাবা-মায়েরা জানতে পারলে, আমাদের খেলাও বন্ধ করে দেবেন। সে ফুটবল হোক বা ক্রিকেট। মাঠে আসা তো দূরের কথা, বাড়ির বারান্দাতেও আর খেলতে দেবেন না।



অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর অশরীরি দাদু গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললেন,
‘ছেলেমানুষ, ওদের কথাই বা কী বলি বল তো তোদের?’ এই কথায় আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম,
‘ছেলেমানুষ? একটু আগেই তো বলছিলেন ওরা আমাদের বাবাদের চেয়েও বয়সে বড়ো। ওরা যদি ছেলেমানুষ হয়, আমরা তাহলে কী?’ অশরীরি দাদু একটু অপ্রস্তুত হয়ে মাথা ঘাড় চুলকে বললেন,
‘ওঃ হো, ওদের আর বয়েস হলো কোথায়? তার আগেই তো অশরীরি হয়ে গেল! বেঁচে থাকলে তবে না, বয়েস বাড়বে? অশরীরিদের বয়েস বাড়ে না, রে। তারা যে বয়সে মারা যায়, সেই বয়েসেই আটকে থাকে, বাড়েও না, কমেও না। ওদের দেখে কি মনে হচ্ছে, ওরা তোদের বাবাদের থেকে বয়েসে বড়ো? বেঁচে থাকলে আমারও এখন আটানব্বই বছর বয়েস হতো, আমাকে দেখে মনে হচ্ছে? আমি মারা গেছিলাম বাষট্টি বছর বয়েসে। আজ ছত্রিশ বছর ধরে একই বয়েসে আটকে আছি’। আমরা দুজনেই এই কথায় খুব অবাক হলাম। বললাম,
‘তাই বুঝি? অশরীরিদের এমন হয়!’ অশরীরি দাদু আমাদের কথায় তেমন কান দিলেন না, আনমনে বললেন,
‘সেদিনটা আমার খুব স্পষ্ট মনে পড়ে আজও, প্রায় ছত্রিশ বছর আগেকার কথা। ১৯৭৯ সালের ১৩ই মে, শনিবার। পোড়ামাতলার লিগ খেলা সেবার শুরু হয়ে গেছে। লিগের চারটে খেলা আমাদের বরুণ সংঘ খেলে ফেলেছে, রেজাল্ট মোটেও ভালো নয় দুটো হার, একটা ড্র, আর একটা মাত্র এক গোলে জয়। বিজন হালদার রোজ কলকাতায় যাওয়া আসা করত, সেই খবর দিল। বরুণ সংঘের সকলেই তখন চাইছিল, লাট্টু আর লেত্তি তাড়াতাড়ি এসে খেলাটা ধরুক। তার আগের দুবার বরুণ সংঘ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, আর এবার যদি সেমি ফাইন্যালেও না উঠতে পারে, লজ্জার শেষ থাকবে না।
আমরা তখন কলকাতাতেই থাকতাম ওরা দুজন কলকাতার স্কুলে পড়ত। আর লম্বা ছুটিছাটায় আমরা পোড়ামাতলায় আসতাম। ছোটবেলা থেকেই লাটু-লেত্তি দু’ভাইয়েরই খেলাধুলোয় খুব ঝোঁক, আর খেলতও বেশ ভালোই। ওদের স্কুলের ইন্টারক্লাস ফুটবল আর ক্রিকেট - দুটো প্রতিযোগিতায় ওদের ক্লাস সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ওদের স্কুল টিমেও ওরা দুভাই রেগুলার খেলত। সেবার তের তারিখ শনিবার স্কুল হয়ে ওদের গরমের ছুটি পড়ে গেল। আমরা ঠিক করেছিলাম ওইদিনই বিকেলের দিকে রওনা হয়ে পোড়ামাতলা চলে আসব। পরেরদিন রবিবার বিকেলে আমাদের বরুণ সংঘের একটা ম্যাচ ছিল খুব জরুরি ম্যাচ, পোড়ামাতলা স্বাধীন সংঘের সঙ্গে। ওদের টিমও খুব ভালো টিম। আগের দুবার আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, ওরা হয়েছিল রানার্স। শুনেছিলাম, সেবার স্বাধীন সংঘ ওদের টিমটাকে ঢেলে সাজিয়েছিল, আমাদের টিমটাকে হারানোর জন্যে। কাজেই, লিগম্যাচে একবার যদি স্বাধীন সংঘকে হারাতে পারি, লিগের চেহারাটাই পালটে যাবে।
বিকেলের দিকে রেডি হয়ে আমাদের গাড়িটা নিয়ে বেরোবার মুখে, হঠাৎ উঠল কালবোশেখির ঝড়, তার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টিবৃষ্টিটা ধরলে বেরোব বলে, অপেক্ষা করতে করতে সন্ধে হয়ে গেল। ঝড় থেমে গেল, কিন্তু বৃষ্টিটা থামলনা, পড়তেই লাগল। একবার ভেবেছিলাম, সেদিন আর বেরোব না, পরের দিন সকাল সকাল বেরোব। কিন্তু লাট্টু-লেত্তি রাজি হল না। আমাদের গাড়ি চালাত কানাইলাল, সেও দেখলাম খুব উৎসাহী। ভাবলাম, কতটুকু আর পথ, কলকাতা থেকে গাড়িতে ঘন্টা তিনেকের ব্যাপার, চলেই যাই।
সন্ধের মুখে আমরা বাড়ি থেকে বেরোলাম। আমি ছিলাম সামনের সিটে, কানাইলালের পাশে। পিছনের সিটে লাট্টু আর লেত্তি। কলকাতা ছাড়িয়ে জিটি রোডে উঠতেই বোঝা গেল, আমাদের কপালে দুঃখ আছেএমনিতেই রাস্তার বেহাল অবস্থা। ঝড় জলে রাস্তার খানাখন্দগুলো জলে ভরে গেছে। আমাদের ডানপাশ বরাবর কলকাতা ঢোকার জন্যে অজস্র লরি, দাঁড়িয়ে রয়েছে। সঙ্কীর্ণ রাস্তার মধ্যে উল্টোদিক থেকে আসা অন্য গাড়ি সামলে আমাদের গাড়ি চলতে লাগল শামুকের গতিতে, গাড্ডায় নাচতে নাচতে। পনের মিনিটের পথ পার হতে লেগে গেল প্রায় একঘন্টা। চিন্তা বাড়ছিল। এরকম চললে আমাদের পোড়ামাতলা পৌঁছতে রাত বারোটা-একটা বেজে যাবে। ঘন্টা দুয়েক পর রাস্তা একটু ফাঁকা পেয়ে কানাইলাল গাড়ির গতি বাড়াল। আমার চিন্তাও একটু কমল, যাক দশটা – এগারোটার মধ্যে আশা করি পৌঁছে যাবো। তখনই বিকট একটা শব্দ করে, আমাদের গাড়িটা, জলে ভরা একটা বড়ো গাড্ডায় বিশাল একটা হোঁচট খেল। আমরা সকলে তালগোল পাকিয়ে একসা। তারপর কী যে হল, কে জানে!
কিছুক্ষণ পরে আমরা চারজনে, গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে দেখলাম, আমাদের গাড়িটা উলটে গিয়ে লরির তলায় চেপ্টে শুয়ে আছে। ভাগ্য খুব ভালো, আমাদের কোন চোট লাগে নি! চারদিক থেকে দৌড়ে এসে অনেক লোক এসে ঘিরে ফেলেছে জায়গাটা, তারা ঝুঁকে পড়ে আমাদের দেখছিল। আশ্চর্য, আমাদের তারা দেখতেই পেল না! আর আমরাও সেই লোকেদের ভিড় কাটিয়ে দিব্যি বেরিয়ে এলাম! অত লোকের ভিড়ে, কোন লোকের সঙ্গে আমাদের ঠেলাঠেলি বা ধাক্কাধাক্কি করতে হল না! খুব অবাক লাগলেও আমরা চারজন বেরিয়ে এসে হাঁফ ছাড়লাম। রাস্তার ধারে একটা কালভার্টের দেওয়ালে বসে, আমি কানাইকে জিগ্যেস করলাম, গাড়িটাতো গেল, এখন কিভাবে যাবি?
কানাই উত্তর দেবে কি, তার মধ্যে এক দঙ্গল ছোকরা এসে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল, দেওয়ালের ওপর। আমরা চার চারজন মানুষ যে ওখানে বসে রয়েছি, তারা কেয়ারই করল না? চোখে দেখতে পায় না নাকি? দেয়ালের ওপর উঠে ওরা আমাদের গাড়িটাকেই দেখার চেষ্টা করছে। ওরা ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতে পারে নি। আমরা ওই ভিড়ের ভেতর দিয়ে আরামসে বেরিয়ে এলাম; আর এই জোয়ান, ছোকরাগুলো ঢুকতেই পারলা না! আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল । তারপর শুনলাম, ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে,
‘কেউ বেঁচে আছে বলে, মনে হচ্ছে?’
‘পাগল? তাই আবার থাকে, যা হয়েছে, ইস্‌স্‌স্‌’।
আমার মনে হল, আমরা তাহলে কারা? আমাদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না, নাকি? ওই উৎকট ভিড়, আমরা সুন্দর কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম, কী করে? এতবড়ো ঘটনার পরেও আমাদের শরীরে কোন আঁচড়টুকুও লাগল না, কেন? তবে কি আমাদের শরীরই নেই? আমরা সবাই অশরীরি? তার মানে আমরা চারজনেই এখন...। প্রথমেই আমার মনে পড়ল আমার ছেলে আর বৌমার কথা, কি জবাব দেব? যখন জিগ্যেস করবে, “বাবা, আপনার কাছে ছেলেদুটোকে রেখে গেলাম, এ আপনি কী করলেন, বাবা?” ওরা কলকাতায় ছিল না, কলেজের কি একটা কাজে দুজনেই দিল্লি গিয়েছিল মাসখানেকের জন্যে। আমার ছেলে-বৌমা দুজনে  একই কলেজে ইতিহাস পড়াত।  তারপর মনে হল, আমাকে তো আর ওরা দেখতেই পাবে না, জিগ্যেস করবে কী?
এতদিন আমরা কলকাতার বাড়িতেই ছিলাম। অশরীরি হলেও সংসারের মায়া কাটাতে পারিনি। আমার ছেলে-বৌমা রিটায়ার করেছে অনেকদিন। সারাটাদিন বাড়ির বারান্দায় বসে থাকত একদম চুপ করে, একটাও কথা বলত না। দূরের দিকে তাকিয়ে থাকত, দেখত না কিছুই, শুধু তাকিয়ে থাকত। আমাদেরই কথা ভাবত নিশ্চয়ই, লাট্টু আর লেত্তির কথা। বৌমা মারা গেলেন বছর চারেক আগে, তারপর আমার ছেলেও মারা গেল গতবছর। আমার এক ভাইপো এখন বাড়িটা বেচে দিয়েছে প্রোমোটারকে, কলকাতার বাড়ি ভেঙে, এখন ফ্ল্যাট বাড়ি উঠছে। বাড়ি ভাঙা শুরু হতেই আমরা চলে এলাম এই বাড়িতে। দেখলাম এই বাড়িই আমাদের থাকার পক্ষে জুতসই’।
অনেকক্ষণ কথা বলে অশরীরি দাদু থামলেন। আমরা সকলেই চুপ করে রইলাম। একটা দুর্ঘটনা থেকে হাজরাচৌধুরিদের সুন্দর পরিবারটা কিভাবে ছারখার হয়ে গেল, সেটাই ভাবছিলাম। মনটা বেশ ভার হয়ে গেল। বাবার মুখে এই দুর্ঘটনার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু তখন ওই ঘটনার এমন ভয়ংকর পরিণতি অনুভব করিনি। আজ করলাম। আমি অশরীরি দাদুকে জিগ্যেস করলাম,
‘আপনার ছেলে এবং বৌমা তো মারা গেছেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় নি’? অশরীরি দাদু্র গলাটা একটু যেন কান্নাধরা, তিনি বললেন,
‘না রে, পাগল। তা হয় না। তোরা মনে করিস, মানুষ মরে গেলে, সবাই একই ভুত হয়। তা হয় না, রে। দুর্ঘটনায় মারা গেলে আমাদের মতো অশরীরি হয়েই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে অন্য লোকে চলে যেতে হয়। সে লোকে আমাদের যাওয়ার উপায় নেই। সেই লোকে কি হয় ঠিক জানিও না’।


অনেকক্ষণ পরে অশরীরি দাদু একটু কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে আবার বললেন,
‘কথা বলতে বলতে অনেক দেরি করিয়ে দিলাম তোদের। তোদের বাড়িতে খোঁজ খবর শুরু হয়ে গেছে। তোরা এখন বাড়ি যা। তার আগে চট করে দরকারি কথাটা বলে নিই। এবারের ফাইন্যালে লাট্টু-লেত্তি যা করে ফেলেছে, সে তো ফেরানো যাবে না। এই কথা যেন আর পাঁচকান না হয় দেখিস। আর আমার একটা অনুরোধ, ওরা দুজন ছেলেমানুষ, সারাদিন এই হানা বাড়িতে ঝোপে ঝাড়ে ঘুরে বেড়ায়। ওদের কি আর ভালো লাগে, বল? আমি বলি কী,  তোরা যখন নিজেরা খেলিস ওদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে খেল না। ওরা যে ভালোই খেলে, সে তো তোরা দেখেছিস। ওদের থেকে শিখে তোরা আরো ভালো খেলতে পারবি, আর ওদেরও সময়টা ভালোই কাটবে। ধরে নে লাট্টু আর লেত্তি তোদের কোচ। ওরা ক্রিকেটও দারুণ খেলে, যেমন ব্যাটে, তেমনি বলে। এখনই কিছু বলতে হবে না। ভাবনা চিন্তা করওরা দুজনেও খেলার সঙ্গী পাবে। তোদের খেলার উন্নতি হলে, বরুণসংঘ আবারও চ্যাম্পিয়ন হবে’।
আমরা উঠে পড়লাম। অশরীরি দাদুকে নিচু হয়ে প্রণাম করলাম দুজনেই। হাত দিয়ে ধোঁয়া ধরার মতো, কিংবা জানালা দিয়ে ঘরের মেঝেয় এলিয়ে পড়ে থাকা নারকেল গাছের ঝিলমিল ছায়া ধরার মতো। অশরীরি দাদু বললেন,
‘থাক, থাক। ওসব আবার কেন? মানুষ আবার কবে কোন দিন অশরীরির পায়ে হাত দিয়েছে’?
আমি একটু হেসে বললাম,
‘আসছি, দাদুলাট্টু, লেত্তি, চললাম রে। আজ বিকেলে, মাঠে দেখা হবে। প্র্যাকটিস আজ থেকে শুরু হলেই ভালো’।

--০০--

কোন মন্তব্য নেই: