"চিরসখা হে" - শ্রীমদ্ভাগভবৎ গীতার অনুবাদ - দশম অধ্যায়
দশম অধ্যায়ঃ বিভূতিযোগ
১০/১
|
শ্রীভগবান বললেন- হে মহাবীর, আমার পরম তত্ত্বকথা আমি আরও একবার বলছি,
শোনো। তোমার মঙ্গলকামনায় যে কথা আমি এখন বলব, তাতে তুমি খুশীই হবে।
|
১০/২
|
দেবতারা কিংবা মহর্ষিরা কেউই আমার আবির্ভাবের তত্ত্বটি জানেন না।
কারণ আমিই সমস্ত দেব ও মহর্ষিদের উৎপত্তির আদি কারণ।
|
১০/৩
|
আমার জন্ম নেই, আমি অনাদি এবং সর্বলোকের আমিই ঈশ্বর, এই তত্ত্ব যিনি
জানেন, তিনি এই পৃথিবীর সমস্ত মোহ ত্যাগ করে, সমস্ত পাপ থেকেই মুক্ত হন।
|
১০/৪-৫
|
বুদ্ধি, জ্ঞান, অনাসক্তি, ক্ষমা, সত্য, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দমন এবং
সংযম, সুখ, দুঃখ, জন্ম ও মৃত্যু, ভয় এবং অভয়, অহিংসা, সমদর্শিতা, সন্তোষ,
তপস্যা, দান, খ্যাতি ও অখ্যাতি – জীবের এই সমস্ত ভাব আমিই সঞ্চার করে থাকি।
|
১০/৬
|
পুরাকালে সাত মহর্ষি, চার মুনিকুমার এবং চোদ্দজন মনু আমারই আত্মার
প্রভাবে, আমার মন থেকে জন্মেছিলেন এবং তাঁরাই এই জগতের সকল প্রজা সৃষ্টি
করেছিলেন।
[ভৃগু, মরীচি, অত্রি, পুলহ, অঙ্গিরা, ক্রতু ও পুলস্ত – সাত মহর্ষি;
সনক, সনন্দন, সনৎকুমার ও সনাতন – চার কুমার; স্বায়ম্ভূব, স্বারোচিষ, উত্তম,
তামস, রৈবত, চাক্ষুষ, বৈবস্বত, সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ব্রহ্মসাবর্ণি,
ধর্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, দেবসাবর্ণি ও ইন্দ্রসাবর্ণি – চোদ্দজন মনু।]
|
১০/৭
|
যিনি আমার এই বিভূতি ও যোগ সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তিনি অবিচলিত
একনিষ্ঠ সাধনায় আমার সঙ্গেই যে যুক্ত হন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
|
১০/৮
|
এই সমস্ত জগৎ আমারই সৃষ্টি, আমার থেকেই সমস্ত জগৎ প্রবর্তিত হয়, এই
তত্ত্ব জেনে জ্ঞানীজন একান্ত ভক্তিভাবে আমার ভজনা করেন।
|
১০/৯
|
আমাতে মন এবং প্রাণ সম্পূর্ণ সমর্পণ ক’রে, জ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে
সবসময় আমাকে নিয়ে আলোচনা ক’রে, সন্তোষ লাভ করেন ও আনন্দ পান।
|
১০/১০
|
যাঁরা সর্বদা আত্মস্থ অবস্থায়, একান্ত ভক্তিতে আমার ভজনা করেন, সেই
জ্ঞানী ব্যক্তিদের আমিই আমার এই
তত্ত্বের সম্যক জ্ঞান দান করি, আর সেই জ্ঞানের উপলব্ধিতেই তাঁরা আমাকে
নিজেদের আত্মায় লাভ করেন।
|
১০/১১
|
তাঁদের প্রতি করুণাবশেই, আমি তাঁদের আত্মায় বাস ক’রে তাঁদের অন্তরে
জ্ঞানের দীপ জ্বালাই, সেই দীপ্তিতে তাঁদের অন্তর থেকে অজ্ঞানের সকল অন্ধকার আমিই
দূর করে দিই।
|
১০/১২-১৩
|
অর্জুন বললেন – তুমিই পরম ব্রহ্ম, তুমিই পরম আশ্রয় এবং তুমি পরম পবিত্র।
তুমিই সেই শাশ্বত দিব্য পুরুষ, যাঁর আদি নেই, যাঁর জন্ম নেই এবং যিনি এই জগতের
সর্বত্র ব্যাপ্ত। এমন কথা আমি সমস্ত ঋষি, দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল ও ব্যাসদেবের
কাছেও শুনেছি। এখন তুমি নিজেও সেকথাই বর্ণনা করলে।
|
১০/১৪
|
হে কেশব, আমি বিশ্বাস করি তুমি যা বললে, তা সবই সত্যি, যেহেতু, হে
ঈশ্বর, তোমার এই মানবরূপ না দেবতারা জানেন, না দানবরা উপলব্ধি করতে পারে।
|
১০/১৫
|
হে পুরুষোত্তম, তুমিই সকল ভূতের স্রষ্টা, সকল ভূতের নিয়ন্তা এবং
তুমিই সমস্ত দেবতাদের দেবতা, এই জগতের প্রভু। তুমি ছাড়া অন্য আর কেউ তোমার
আত্মার এই পরম স্বরূপ জানতে পারে না।
|
১০/১৬
|
যে যে বিভূতি দিয়ে এই জগতের সর্বত্র তুমি ব্যাপ্ত রয়েছ, নিজের সেই সব
পরমবিভূতির দিব্যস্বরূপ ব্যাখ্যা করা, একমাত্র তোমার পক্ষেই সম্ভব।
|
১০/১৭
|
হে যোগেশ্বর, সর্বদা তোমার চিন্তা করতে করতে কিভাবে তোমাকে জানব? আর
হে ভগবান, কী কী ভাবেই বা আমার চিন্তায় শুধু তুমিই থাকবে?
|
১০/১৮
|
হে জনার্দন, তোমার আত্মযোগের ঐশ্বর্য্য এবং তোমার বিভূতির কথা
সবিস্তারে আরও একবার বলো। কারণ তোমার এই অমৃতবাণী বার বার শুনেও আমার তৃপ্তি
হচ্ছে না।
|
১০/১৯
|
শ্রীভগবান বললেন – হে কুরুশ্রেষ্ঠ, আমার অলৌকিক বিভূতির মধ্যে যেগুলি
প্রধান, তার কথাই আমি এখন তোমাকে বলব, কারণ আমার এই বিভূতি বিশ্বব্যাপী, তার কোন
অন্ত নেই।
|
১০/২০
|
হে জিতনিদ্র অর্জুন, সমস্ত জীবের অন্তরে আমিই আত্মা বা চৈতন্যরূপে
বাস করি এবং আমিই সমস্ত জীবের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশের একমাত্র কারণ।
|
১০/২১
|
দ্বাদশ আদিত্যদের মধ্যে আমিই বিষ্ণু, জ্যোতির্মণ্ডলের মধ্যে আমিই
অংশুমান সূর্য, সপ্তবায়ুর মধ্যে আমিই মরীচি, সহস্র নক্ষত্রদের মধ্যে আমিই
চন্দ্র।
[ধাতা, মিত্র, অর্যমা, রুদ্র, বরুণ, সূর্য, ভগ, বিবস্বান, পুষা,
সবিতা, ত্বষ্টা ও বিষ্ণু – এঁরা দ্বাদশ আদিত্য। আর আবহ, প্রবহ, বিবহ, পরাবহ,
উদ্বহ, সংবহ ও পরিবহ – এই সাতটি মরুৎ বা বায়ু।]
|
১০/২২
|
চার বেদের মধ্যে আমিই সামবেদ, দেবতাদের মধ্যে আমিই বাসব, সকল
ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমিই মন, এবং সমস্ত জীবের অন্তরে আমিই চেতনা।
|
.১০/২৩
|
একাদশ রুদ্রের মধ্যে আমিই শঙ্কর, যক্ষ ও রাক্ষসের মধ্যে আমিই ধনপতি
কুবের, অষ্ট বসুর মধ্যে আমিই অগ্নি, সুউচ্চ পর্বতের মধ্যে আমিই মেরুপর্বত।
[একাদশ রুদ্র- অজ, একপাদ, অহিব্রধ্ন, পিনাকী, অপরাজিত, ত্র্যম্বক,
মহেশ্বর শংকর, বৃষাকপি, শম্ভু, হরণ ও ঈশ্বর। অষ্ট বসু – আপ, ধ্রুব, সোম, ধর,
অনিল, অগ্নি, প্রত্যূষ ও প্রভাস।]
|
১০/২৪
|
হে অর্জুন, জেনে রাখো, সমস্ত পুরোহিতগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আমিই
বৃহষ্পতি। সমস্ত সেনাপতিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আমিই স্কন্দ, সমস্ত জলাশয়ের মধ্যে
আমিই সাগর।
|
১০/২৫
|
মহর্ষিদের মধ্যে আমিই ভৃগু, সমস্ত বাক্যের মধ্যে আমিই একাক্ষর প্রণব,
সমস্ত যজ্ঞের মধ্যে আমিই জপযজ্ঞ, সমস্ত স্থাবরের মধ্যে আমিই হিমালয়।
|
১০/২৬
|
সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমিই অশ্বত্থ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমিই নারদ,
গন্ধর্বগণের মধ্যে আমিই চিত্ররথ, সিদ্ধযোগীগণের মধ্যে আমিই কপিল মুনি।
|
১০/২৭
|
জেনে রাখো, অমৃত লাভের জন্যে সমুদ্র মন্থনের সময় যে শ্রেষ্ঠ অশ্বটির
উৎপত্তি হয়েছিল, আমিই সেই উচ্চৈঃশ্রবা, শ্রেষ্ঠ হাতিদের মধ্যে আমিই ঐরাবত আর
সমস্ত মানুষের মধ্যে আমি নৃপতি।
|
১০/২৮
|
সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে আমিই বজ্র, সমস্ত গাভীর মধ্যে আমিই কামধেনু,
জীব প্রজননে আমিই কামদেব কন্দর্প, সমস্ত সর্পগণের মধ্যে আমিই বাসুকি।
|
১০/২৯
|
নাগেদের মধ্যে আমিই অনন্তনাগ, সমস্ত জলচরদের দেবতা আমিই বরুণ,
পিতৃলোকে আমিই অর্যমা আর এই জগতের নিয়ন্ত্রণকর্তা আমিই যম।
|
১০/৩০
|
দৈত্যদের মধ্যে আমিই প্রহ্লাদ, অনন্ত সময় প্রবাহের নিয়ন্তা আমিই কাল,
পশুদের মধ্যে আমিই সিংহ, পক্ষীদের মধ্যে আমিই বিনতাপুত্র গরুড়।
|
১০/৩১
|
গতির মধ্যে আমিই বাতাসরূপী পবন, অজেয় বীরদের মধ্যে আমিই শ্রীরাম,
মাছেদের মধ্যে আমিই মকর, আর সমস্ত নদীর মধ্যে আমিই গঙ্গা।
|
১০/৩২
|
হে অর্জুন, আমিই সকল পদার্থের আদি, মধ্য এবং অন্ত। সমস্ত বিদ্যার
মধ্যে আমিই পরমজ্ঞান, আমিই তার্কিক পণ্ডিতগণের বিতর্কিত মতবাদ।
|
১০/৩৩
|
সমস্ত অক্ষরের মধ্যে আমিই অ-কার। সমস্ত সমাসের মধ্যে আমিই দ্বন্দ্ব।
আমিই অনন্তকাল এবং সর্ব ফল প্রদানকারী বিশ্ববিধাতা।
|
১০/৩৪
|
আমিই সর্বানাশা মৃত্যু আবার আমিই মঙ্গলময় ভবিষ্যতের স্রষ্টা। কীর্তি,
শ্রী, বাক্য, স্মৃতি, মেধা, ধৈর্য ও ক্ষমা রূপে আমিই সকল নারীর গুণাবলী।
|
১০/৩৫
|
আমিই সামবেদের মধ্যে মহৎ সাম। সমস্ত ছন্দের মধ্যে আমিই গায়ত্রী।
বারোমাসের মধ্যে আমিই অগ্রহায়ণ, ছয় ঋতুর মধ্যে আমিই বসন্ত।
|
১০/৩৬
|
সমস্ত প্রতারকের মধ্যে আমিই পাশাখেলার চাতুরি, শক্তিশালীদের মধ্যে
আমিই শক্তি, উদ্যমী লোকেদের মধ্যে আমিই অধ্যবসায়, আর আমিই বিজয়ীদের জয়।
|
১০/৩৭
|
আমি বৃষ্ণিবংশের মধ্যে বাসুদেব-কৃষ্ণ, পাণ্ডবদের মধ্যে আমিই ধনঞ্জয়-অর্জুন,
মুনিদের মধ্যে আমিই ব্যাসদেব, আর কবিদের মধ্যে কবি শুক্রাচার্য।
|
১০/৩৮
|
শাসকদের হাতে আমিই দণ্ড, জয়ের ইচ্ছায় আমিই রণনীতি, গোপন বিষয়ে আমিই
মৌনী আর জ্ঞানীদের মধ্যে আমিই জ্ঞান।
|
১০/৩৯
|
হে অর্জুন, বিশ্বে যা কিছু তোমার দৃষ্টিতে অথবা অনুভবে ধরা দেয়, সেই
সবকিছুর মূল আমি। আমায় ছাড়া থাকতে পারে, এই চরাচরে এমন কিছুই নেই।
|
১০/৪০
|
হে অর্জুন, আমার অলৌকিক বিভূতির কোন সীমা নেই, আমার সেই বিশ্বব্যাপী
বিভূতির খুব সামান্য অংশই তোমার কাছে ব্যাখ্যা করলাম।
|
১০/৪১
|
এই পৃথিবীতে ঐশ্বর্যবান, শ্রীমান কিংবা প্রাণশক্তিতে ভরপুর যেখানে যা
কিছু দেখতে পাবে, আমার এই বিভূতির অংশ থেকেই তাদের সৃষ্টি, এই তত্ত্বটি জেনে
রাখো।
|
১০/৪২
|
কিন্তু হে অর্জুন, তোমার এত বেশী জানার কি প্রয়োজন? শুধু এইটুকু জেনে
রাখো যে, আমার খুব সামান্য একটি অংশ দিয়েই আমি এই নিখিল বিশ্বচরাচরকে ধারণ করে
আছি।
|
বিভূতিযোগ সমাপ্ত
"চিরসখা হে" বইটি কিনতে হলে যোগাযোগ করুন, লেখকের সঙ্গে এই মেলেঃ-
kishoreghosal@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন