Translate

বুধবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৯









"দশে দশ" বড়দের দশটি গল্পের সংকলন।

প্রকাশিত হয়েছে।

বই কেনার লিংকঃ-

http://sristisukh.com/ss_wp/product/%e0%a6%a6%e0%a6%b6%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a6%b6/






সংক্ষিপ্ত রিভিউ ঃ

বর্ষীয়ান সাহিত্যিক শ্রী কিশোর ঘোষালের এই গল্প সংগ্রহটা ব্যতিক্রমী একটি প্রয়াস বইকি! কলমচি ব্রাত্য বিষয় ও ব্রাত্যজনের জীবনকে তুলে নিয়েছেন কলমে। উঠে এসেছে পরশ, ধুলি, মনা, জিতেনের মেয়ে, ফটিক, হীরালালজির মত সেই অজস্র চরিত্ররা— শহরের আলোকিত রাজপথে, অন্ধকার গলিতে, বস্তিতে, হাইরাইজে, রুটের বাসে, লোকাল ট্রেনে যাদের দেখা মেলে; ঋদ্ধ বাঙালিমানস যাদের জীবনকে সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে পিরামিড বা মহাকাশের গভীরে কিংবা তান্ত্রিকের অজাচারে জীবন ও বাস্তবতার অনুসন্ধানে উপস্থিত ব্যস্ত। এবং প্রকাশককেও ধন্যবাদ। সাহস করে বইটায় পুঁজি এবং নিজেদের লোগো বিনিয়োগ করছেন বলে। এই মুহূর্তের বাণিজ্যসফল বাংলা সাহিত্যের প্রেত, রাক্ষস ও ভিনগ্রহীদের কল্পজগতে বাস্তবজীবনের এই ছবিগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার সাহস খুব কম প্রকাশনেরই হবে।
– দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
* * *
এই সংকলনের সপ্তম গল্প "উকুন"। কিছুটা পড়লেই ঘৃণা আর বিরক্তিতে নাক কুঁচকে ওঠে আমাদের মতো "ভদ্দরনোক" দের, কিন্তু এই পরিবেশেও ভালোবাসার ফুল ফুটেছিল ওদের মনে মনে...

ধুলি পাঁচ নম্বর উকুনটা মেরে, ছ নম্বরটাকে চুলের গোড়া থেকে তুলে আনল। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখে রেখে, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে চেপে সবে মারতে যাবে, এমন সময় বাসি এসে তাকে ডাকল। দাওয়ার নীচে দাঁড়ানো উত্তেজিত বাসন্তী হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, কাল রাত্রে দিল্লী মেলের তলায় একটা লোক কাটা পড়েছে। এমন অবস্থা হয়েছে, লোকটাকে চেনা যাচ্ছে না।
খবরটা শুনে ধুলি বলল– ‘হারামি শালা’। কাকে বলল, বাসিকে, নাকি কাটা পড়া সেই অচেনা লোকটাকে? নাকি বাঁ আঙুলে নখের উপরে রাখা পালিয়ে যাওয়া উকুনটাকে? যেটাকে সে ডানহাতের বুড়ো আঙুলের নখে চেপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। বিরক্ত মুখে ধুলি উকুনটাকে খুঁজতে লাগল। নিজের কোলের শাড়ির ওপর, মাটিতে। দেখতে পেল না, ছোট্ট পরগাছা এই পোকাগুলো কি শয়তান, কি শয়তান। ওইটুকু গতর হলে কি হবে, দাঁতের কি ধার। উকুনের আবার গতর, তার আবার দাঁত! কিছুক্ষণ খুঁজে ধুলি হাল ছেড়ে দিল। মাথার মধ্যে উকুনের জবর দখল রাজ্যপাটের জ্বালায়, পাগলির মতো দুহাতে মাথাটা চুলকে নিল খানিক। তাই দেখে বাসি ফিক করে হেসে উঠতে, ধুলি মুখ ঝামটে বলল-
‘আ মোলো, হাসছিস ক্যানে লা’? তবুও বাসি হাসছিল, হাসতে হাসতে বলল
‘জটে বুড়ি, তোমাকে ঠিক জটে বুড়ি লাগছে’।
‘আবাগীর বেটি, তুই জটে বুড়ি, তোর চোদ্দগুষ্টি জটে বুড়ির ছা’।

ধুলির গালাগালির দাপটে বাসির মুখ ম্লান হয়ে গেল। সে পলেস্তারা খসা পিলারের নোনাধরা ইঁটের গা খুঁটতে লাগল। তার নখের ডগায় লাল ইঁটের মিহিন গুঁড়ো। যেন মেটে রঙের সিঁদুর।
কাজকম্মের লোভ দেখিয়ে ছুকরি মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এসে মাসীর হাতে তুলে দেওয়াই আড়কাঠিদের কাজ। চায়ের যেমন লিকার হয়, হয় ফ্লেভার, আর সেই মতো যেমন তার দাম ওঠা পড়া করে। ছুকরিদেরও ‘লিবার’ আর ‘ফিবার’ অনুযায়ী মাসী দর দেয়। মাসীর প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার চোখ জরিপ করে নিতে পারে, কোন ছুকরি কালে হয়ে উঠবে ঠমকদার ডবকা, আর কে হবে ম্যাদামারা কাঁদুনি। বাসি এ লাইনে সবে বছর তিনেক এসেচে। এখনো ঠিক যেন মন বসে নি। প্রথম বছরখানেক তো মাসীর সঙ্গে খুব আকচাআকচি। আজকাল অনেকটাই থিতু হয়ে এসেছে, বুঝে গেছে, যে জায়গায় সে এসে পড়েছে, সেখান থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। আর বের হলেও সে ফিরে যেতে পারবে না তার নিজের বাপ-ভাইয়ের সংসারে।
নষ্টামাগীকে ঘরে তুলে সংসারের অকল্যাণ ডেকে আনবে কোন বাপ, মা, ভাই, বোন? যদিও আরেকটা পথ আছে, রেলে মাথা দেওয়া কিংবা গলায় দড়ি। সে পথটার কথা বাসি ভাবে নি তা নয়, কিন্তু পছন্দ হয় নি। সে বাঁচতে চায়। মরে গিয়ে তার কি লাভ? কিংবা কি আহামরি ক্ষতি হবে তার পরিচিত পরিজনেদের। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে খুব জোর বলবে, ‘গেছে, ভালোই হয়েছে, আপদ বিদেয় হয়েছে’। বাসিকে ধুলির বেশ লাগে। বছর তিনেক এই লাইনে আসার পরেও সে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, তার ফেলে আসা গ্রামজীবনের ছায়া। বাসির কথাবার্তায়, আচরণে ধুলি পরশ পায় সেই অনুভবের। দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে সে আগ্রহের সঙ্গে বাসির কথা শোনে দুপুরের নির্জন অবসরে, তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে।
ধুলির মুখঝামটা খেয়ে পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো বাসন্তীর দিকে একবার তাকালো ধুলি। বেচারি মুখ হাঁড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া হল ধুলির, বলল
‘কিরে, বাসি? বাজার যাবি না’?

বাসি কিছু বলল না, চোখ তুলে তাকালো, দু চোখে অভিমান। এই জন্যেই বাসিকে বড়ো ভালো লাগে ধুলির। এই লাইনে অভিমান করবে এমন আহাম্মক কে আছে আর বাসি ছাড়া? সকাল সকাল কার ঠেকা পড়েছে তার এই মুখ ঝামটা শোনার, আর শুনলেও তাকে ছেড়ে দিত? সুদে আসলে মিটিয়ে দিত ধুলির মুখঝামটা। তিনধাপ নেমে, ধুলি বাসির কাছে দাঁড়াল, বাসির থুতনি ধরে বলল
‘কিরে রাগ করেচিস? ওসব ভুলে যা, হঠাৎ মাতাটা গরম হয়ে উটেছিল। যাঃ, থলি নিয়ে আয়, বাজারে যাবি তো’?

ধুলির কথায় বাসি ফিক করে হেসে ফেলে, দু ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ে হাসিমাখা গালে। বাসি বাজারের থলি আনতে দৌড়ে চলে যায় নিজের ঘরের দিকে। তার দৌড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে ধুলির মুখেও অল্প হাসি ফোটে।
কাল সন্ধের ঝোঁকে ঠিক যখন সেজেগুজে সে রেডি হচ্ছে, পাঁচু বদ্যি সুড়সুড় করে ঢুকে পড়েছিল তার ঘরে। ব্যাটা একনম্বরের মেনিমুখো, অলক্ষুণে আর উনপাঁজুরে। বদ্যির নামে ঢেঁড়াকাটি, মিনসে ক লিখতে কলমভাতে। জুতোর চামসে শুকতলার মতো মুখটা তেলপানা করে, সে যখন বলে, আমি হলাম গে পাঁচকড়ি বদ্যি। সে রগড় বড়ো কম নয়। তাদের পাড়ায় হাসির হল্লা ওঠে, মুখ খারাপের কল্লা ওঠে। মাসী ঘরের চালে ঝোলা এত্তবড়ো কদুর মতো দুই বুক দুলিয়ে বলে – ওলো শোন লো শোন, ভারেণ্ডাও বিরিক্ষি আর ত্যালাপোকাও পক্ষি। বদ্যি ব্যাটা যম হাতুড়ে, মিনসে বড়ো মাগ কাতুরে। ব্যাটা ভদ্দরনোকের পাড়ায় কল্কে পায় না, তাই চলে আসে আমদের বগলতলায়, আমাদের গা শুঁকতে..."
*  *  *

এই গল্পের বাকিটা এবং এমন অন্য আরো গল্প নিয়ে "দশে দশ"। ওপরের লিংকে ক্লিক করলেই ঘরে বসে হাত পেয়ে যাবেন ।



কোন মন্তব্য নেই: