Translate

শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮

ছোট্ট হওয়া

(ছোটদের ওয়েব পত্রিকা "জয়ঢাক" এ প্রকাশিত) 

জয়ঢাকে প্রকাশিত আরো গল্প - উপন্যাস পড়তে হলে ক্লিক করুন নিচের লিংকে







প্রফুল্লনগরে তের নম্বরের কোন কোয়ার্টার নেই, বারো নম্বরের পর বারোর এ, তারপরে চোদ্দ। সেদিন পোস্টম্যান রসিকলাল পাণ্ডে এসেছিল বারোর এ-তে চিঠি বিলি করতে। অন্যদিন লোহার নীচু গেটটায় ঠকঠক আওয়াজ করলে, বাড়ির ভেতর থেকে কেউ না কেউ চিঠি নিতে বেড়িয়ে আসে। আজ রসিকলাল দু-তিনবার আওয়াজ করা সত্ত্বেও কেউ বের হল না। রসিকলাল বাড়িটার দিকে নিরীক্ষণ করে দেখল। এই দুপুরবেলা, সামনের ঢাকা বারান্দায় সব বাড়িতেই শাড়ি, গামছা, কাপড় চোপড় শুকোতে দেখা যায়। সে সব কিছুই নেই। তার ওপর সিমেন্টের মেঝেয় বেশ কদিন ঝাঁট না পড়া ধুলো আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শুকনো পাতা। রসিকলাল বুঝতে পারল বেশ কদিন হল বাড়িতে কেউ নেই।
চিঠি গুলো ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, আরেকদিন আসবে ডেলিভারি দিতে, নাকি বন্ধ দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেবে চিঠিগুলো? বেড়ার গায়ে সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে, রসিকলাল লোহার গেট খুলে ঢুকে পড়ল সামনের বাগানে। সিমেন্টের বাঁধানো পথে হেঁটে আসতে ভাবল, আজ না দিলে, এই গরমে আবার ফিরে আসতে হবে কাল বা পরশু, তাছাড়া কাল পরশুও যদি না ফেরে? কতদিন কে জানে, চিঠিগুলো তার জিম্মাতেই রাখতে হবে! তার চেয়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো। একধাপ উঁচু বারান্দার ধারে এসে রসিকলাল দেখল দু’খানা বড়ো বড়ো তালা ঝোলানো বন্ধ দরজার নীচে, চিঠি ঢোকানোর মতো যথেষ্ট ফাঁক আছে। বাঁহাতে রাখা চিঠির বাণ্ডিল থেকে এ বাড়ির দুটো চিঠি ডানহাতে নিয়ে রসিকলাল বারান্দায় ওঠার জন্যে পা বাড়াল। রসিকলাল ছিটকে পড়ল পিছনের সিমেন্ট বাঁধানো সরু রাস্তার ওপর। তার হাতে ধরা চিঠিগুলো ছড়িয়ে পড়ল রজনীগন্ধা আর বেলিফুলের ঝাড়ের ওপর, আর কাঁধের ব্যাগটা ছিটকে গিয়ে পড়ল ওপাশে ঘাসের জমিতে
আচমকা পড়ে গিয়ে রসিকলাল একটু ভয় পেল এবং অবাক হল খুব। গরমটা উৎকট পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার মাথাতো ঘোরে নি! আর কেন কে জানে তার মনে হল, কেউ যেন তাকে সামনে থেকে ধাক্কা মারল। কিছুক্ষণ সিমেন্ট বাঁধানো পথের ওপর বসে একটু ধাতস্থ হয়ে নিল রসিকলাল, তারপর গুছিয়ে তুলে নিল সব চিঠিপত্র আর কাঁধের ব্যাগ। শরীরটা নিশ্চয়ই দুর্বল হয়েছে, সে ঠিক করে ফেলল, আজকে ডিউটি সেরে, কাল থেকে দিনকতক ছুটি নিয়ে বাড়িতে বিশ্রাম নেবে। এ বাড়ির চিঠিদুটো নিয়ে রসিকলাল আবার পা তুলতে গেল বারান্দায় এবং এবারও সে ছিটকে পড়ে গেল পিছনের সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তায়!
রসিকলাল এবারে আর একটুও সময় নষ্ট করল না, কোনমতে চিঠিপত্র আর ব্যাগ তুলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল লোহার গেট পেরিয়ে বড়ো রাস্তায়। ধীরে সুস্থে সাইকেল চালিয়ে সুধীরবাবু দুপুরের খাওয়া সেরে ওয়ার্কশপে যাচ্ছিলেন, রসিকলাল পড়ল গিয়ে তাঁর ঘাড়ে। হুড়মুড়িয়ে দুজনেই পড়লেন রাস্তার ধারে। বেমক্কা ধাক্কায় সুধীরবাবু রেগে উঠেছিলেন খুব, দাঁড়িয়ে উঠে ভেবেছিলেন আচ্ছা করে দেবেন বেয়াক্কেল লোকটাকে বেশ চার কথা শুনিয়ে। কিন্তু রসিকলালকে চিনতে পেরে আর তার চোখ মুখের অবস্থা দেখে সুধীরবাবু সামলে নিলেন নিজেকে। জিগ্যেস করলেন
-কি ব্যাপার বলুন, তো, পাগলা ষাঁড়ে তাড়া করেচে নাকি, অমন ছুটছিলেন কেন উন্মত্তের মতো?
-এই বাড়িতে নিঘ্‌ঘাত ভূত আছে! হাঁফাতে হাঁফাতে রসিকলাল বলল। সুধীরবাবু মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। প্রখর রোদজ্বলা দুপুর, মাথার ওপর গনগনে সূর্য, এই সময়ে ভূত? ভ্রূ কুঁচকে রসিকলালের দিকে তাকিয়ে বললেন-
-আপনাকে ভালো লোক বলেই তো জানতাম। আজকাল নেশা ভাঙ করা হয় নাকি?
-একদম না, স্যার। মা কালীর দিব্বিচা ছাড়া কোন নেশা জীবনে করিনি। চিঠি ডেলিভারি দিতে যাচ্ছিলাম, দু’ দুবার বারান্দায় পা তুলতেই কে যেন ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল! প্রথমবার ভেবেছিলাম, আমার শরীরটাই বোধহয় দুব্বল, মাথাটা ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার ...। কথা শেষ করতে পারল না রসিকলাল, ভয়ে যেন শিউরে উঠল।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনি একা একা যেতে পারবেন তো? অফিসে গিয়ে একটু রেস্ট নিন। হাতের সমস্ত চিঠিই কাঁধের ঝোলায় ভরে রসিকলাল উঠে পড়ল তার সাইকেলে। আজকের ডাক বিলি আপাতত স্থগিত, সে চলে গেল পোস্ট অফিসের দিকে। মাঠের ধারের রাস্তা দিয়ে সাইকেলে তার চলে যাওয়াটা লক্ষ্য করার পর সুধীরবাবু তাকালেন বারোর এ কোয়ার্টারের দিকে।

এই কোয়ার্টারে থাকেন মুকুন্দবাবু, মুকুন্দ বিষয়ী। নাম বিষয়ী হলেও খুবই অমায়িক সজ্জন। মুকুন্দবাবুর চার কন্যা; বছরখানেক আগে বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, মেজ মেয়ে পড়ে ক্লাস টুয়েল্ভে, ছোট দুটো যমজ – দুজনেই ক্লাস সেভেনে উঠেছে। তিন মেয়েকে নিয়ে মুকুন্দবাবু সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছেন, সিমলা কুলু মানালি। ঠিক কবে গেছেন মনে না করতে পারলেও দিন সাত-আট তো হবেই, পনের দিনের প্রোগ্রাম, কাজেই মুকুন্দবাবুর ফিরতে আরো অন্ততঃ দিন সাতেকের ধাক্কা। সুধীরবাবু একবার ভাবলেন ব্যাপারটা মুকুন্দবাবুকে ফোনে জানিয়ে দেবেন, আবার ভাবলেন কি হবে ভদ্রলোককে ব্যতিব্যস্ত করে? পোস্টম্যান কি করতে কি করেছে কে জানে? মুকুন্দবাবুকে জানানোর আগে, অন্ততঃ নিশ্চিত হওয়া দরকার আসল রহস্যটা কি? তিনি সাইকেলে উঠে ওয়ার্কশপের দিকে রওনা হলেন, ঠিক করলেন ডিউটি সেরে ফেরার পথে, এ রহস্যের তদন্তটা সেরে নেবেন, আপাততঃ ওটা তোলা থাক।


সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়ে সাইকেল স্ট্যাণ্ডে নিজের সাইকেলের লক খুলতে খুলতে সুধীরবাবুর দেখা হল নেপাল ঘোষের সঙ্গে। ছোকরা খুব করিতকর্মা আর পরোপকারী, সুধীরবাবু খুব পছন্দও করেন নেপালকে। নেপালের দিকে তাকিয়ে, সুধীরবাবু বললেন –
-এই নেপাল, খুব ব্যস্ত নাকি রে?
-কেন বলোতো, সুধীদা, কোন কাজ আছে?
-একটা জিনিষ দেখাবো, যাবি? নেপাল একগাল হেসে বলল-
-তোমার বাগানে আবার বুঝি স্থলপদ্ম ফুটেছে? সুধীরবাবুর বাগানের খুব শখ, নানান ধরনের ফুলগাছের চর্চা করা তাঁর নেশা। তাঁর গাছে বিশেষ কোনো ফুলটুল এলে তিনি চেনাশোনা সকলকে ডেকে ডেকে দেখান। অনেকটা ছেলে বা মেয়ের প্রাইজে পাওয়া ট্রোফি দেখানোর মতো। তাঁর এই দুর্বলতার কথা অনেকেই জানে। নেপালের কথাটা গায়ে মাখলেন না সুধীরবাবু, বললেন-
-উঁহু, আরো ইন্টারেস্টিং। ভূত। ঠিকঠাক বললে ভূতের ঠেলা, খাবি?
-এই সুধীদা, তোমার শরীর-টরীর ঠিক আছে তো? তোমার সাইকেলটা রেখে, আমারটায় ওঠো, তোমাকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসছি। মুচকি মুচকি হেসে, সুধীরবাবু নেপালকে কাছে ডাকলেন, তারপর খুলে বললেন রসিকলাল পোস্টম্যানের দুপুরের ঘটনাটা। সব শুনেটুনে নেপাল খুব খানিক হো হো করে হাসল, তারপর বলল-
-মুকুন্দদার কোয়ার্টারে ভূতের ঠ্যালা? তুমিও পারো, মাইরি। পোস্টম্যান বলল আর তুমি মেনে নিলে?
-মেনে নিয়েছি তোকে কখন বললাম? বললাম না তদন্ত করে দেখব, যদি ব্যাটা মিথ্যে কথা বলে থাকে, পোস্টফিসে কমপ্লেন করবো। নেশা করে ভরদুপুরে বাড়ি বাড়ি ডাক বিলি করছে। ওই সময়ে বাড়িতে শুধু মেয়েরাই থাকে, আমরা তো সব ওয়ার্কশপে। কিছু একটা হয়ে গেলে?
-হুঁ, কথাটা মন্দ বলো নি। তবে, চলো ঘুরেই আসি একবার মুকুন্দদার কোয়ার্টারে। দাঁড়াও ওদেরকেও ডাকি। ওই সময়েই সাইকেল স্ট্যাণ্ডে সাইকেল বের করতে ঢুকল দেবু নস্কর আর প্রভাত পাল। ওরা নেপালের প্রায় সমবয়সী কলিগ, খুব ভাব তিনজনে। নেপাল দেবুকে ডেকে বলল-
-এই দেবু, সাইকেল বের করে তুই আর প্রভু আয় তো, মুকুন্দদার কোয়ার্টারে যাবো।
-মুকুন্দদারা নেই তো, জানিস না? সেখানে গিয়ে কি করবি। প্রভু উত্তর দিল।
.-আয় না, কাজ আছে। রাস্তায় যেতে যেতে বলব, আমি আর সুধীদা এগোচ্ছি, তোরা আয়।

মুকুন্দবাবুর বারোর এ কোয়ার্টারের সামনে চারজনে সাইকেল থেকে নামল। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় আর বাগানের বেড়ার ধারে কিছু বড়ো গাছের জন্যে এখন বাড়িটাকে একটু ছায়া ছায়া মনে হল সুধীরবাবুর। এতটা পথ সাইকেল চালিয়ে বেশ ঘেমে উঠেছিলেন, এখন এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটা শীতল হাওয়ার অনুভূতি পেয়ে তাঁর আরাম লাগারই কথা, কিন্তু তিনি বেশ অস্বস্তি অনুভব করলেন। ওরা তিনজনে লোহার গেটটা খুলে ঢুকল। সুধীরবাবু নিজের সাইকেলটা ধরে গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। নেপাল আর প্রভু আছে সামনে, দেবু ওদের পিছনে। সিমেন্টের বাঁধানো সরু রাস্তাটা পার হয়ে ওরা বারান্দাটার সামলে দাঁড়াল,–
-কই, কিছুইতো হল না, সুধীদা? নেপাল জিগ্যেস করল। তার গলায় ঠাট্টার সুর।
-ওই তো ওই বারান্দাটা, বারান্দায় ওঠ।
সুধীরবাবুর কথা শেষ হবার আগেই নেপাল আর প্রভু ছিটকে পিছনে এসে পড়ল দেবুর ওপর, তারপর তিনজনেই সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তায় চিৎপাত! নেপাল আর প্রভু বারান্দায় ওঠার জন্যে পা রাখতে গিয়েছিল, তাতেই এই বিপত্তিতিনজনেই মাটিতে পড়ে কয়েক সেকেণ্ড হতভম্ব হয়ে পড়ে রইল, তারপর নেপাল চেঁচিয়ে উঠল,
-পালা, দেবু পালা, প্রভু, পালা। ও সুধীদা, তোমার মনে শেষ অব্দি এই ছিল? তারপর তিনজনেই উঠে পড়ে হুটোপুটি করে এক দৌড়ে বেরিয়ে এল লোহার গেট পেরিয়ে রাস্তায়। দম নিতে নিতে চারজনে মিলে তাকিয়ে রইল বারোর এ বাড়িটার দিকে।


এই ঘটনার পর সুধীরবাবু মুকুন্দবাবুকে ফোন করেছিলেন। তাঁর থেকে পুরো ব্যাপার জেনে, মুকুন্দবাবু স্ত্রী আর মেয়েদের সব কথা বললেন, শুনে মুকুন্দবাবুর স্ত্রী খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন-
-তোমাকে তখনই বলেছিলাম, মেয়েদের কথায় না নেচে, চলো মথুরা, বৃন্দাবন কি হরিদ্বার যাই। তা আমার কথা তুমি কানে তুলবে কেন? এখন কি উপায় হবে সেটা বলো, হাত পা গুটিয়ে, বসে না থেকে কিছু একটা ভাবো। মুকুন্দবাবু খুব অবাক হয়ে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন -
-বোঝো, সিমলা, কুলুর সঙ্গে বাড়িতে ভূতের ঠ্যালার কি সম্পর্ক? আরো অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মুকুন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে থেকে মুকুন্দবাবুর স্ত্রী বললেন –
-এখনো বুঝলে না?
-নাঃ।
-ভুত প্রেতরা কার সঙ্গে থাকে, কার চ্যালা চামুণ্ডা?
-কার? শিব ঠাকুরের আর মা কালীর।
-অ্যাই, এতক্ষণে মাথা খুলছে। পাহাড় দেখা, বরফ দেখা অনেক হয়েছে। বরফ দেখে কার কটা হাত পা গজিয়েছে শুনি? নামার সময় হরিদ্বার হয়ে চলো, ওখানে পুজো দিয়ে গঙ্গাস্নান সেরে গেলে, সব অমঙ্গল ঘুঁচে যাবে।
-কিন্তু রিজার্ভেসন? আমাদের রিজার্ভেসন তো কালকা থেকে, সেটা ক্যান্সেল করালে হরিদ্বার থেকে রিজার্ভেসন পাওয়া যাবে না, খুব রাশ এই সময়টায়।
-সে আমি জানিনা, তুমি জানো আর জানে তোমার রেল কোম্পানী। মুকুন্দবাবুর স্ত্রী দুমদুম করে পা ফেলে চান করতে ঢুকলেন হোটেলের বাথরুমে, সেখান থেকে বললেন – টুম্পি, রুনুঝুনু, আমার হয়ে গেলে তোরাও চান করে রেডি হয়ে নে, হিড়িম্বা টেম্পলে পুজো দিতে যাবো। মুকুন্দবাবুর মেজমেয়ের নাম টুম্পি আর ছোট দুই যমজ মেয়ের নাম রুনু আর ঝুনু।

বাথরুমের দরজা বন্ধ হবার শব্দ শোনার পর টুম্পি চাপা গলায় বাবাকে জিগ্যেস করল –
-কি হতে পারে বলো তো, বাবা? মুকুন্দবাবু ঠোঁট উল্টে খুব চিন্তিত মুখে বললেন –
-কে জানে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না। টুম্পি বিজ্ঞানের ছাত্রী, ক্লাস টুয়েল্ভে পড়ে। তার ধারণা, পৃথিবীতে বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছু নেই, সব ব্যাপারের ব্যাখ্যাটা হয়তো আমরা ঠিক ধরতে পারিনা, কিন্তু সেটা বুঝতে পারলেই সব জলবৎ তরলং, দুই আর দুইয়ে চার। একটু চিন্তা করে সে বলল -
-ম্যাগনেটিক ফিল্‌ড্‌। আমার মনে হচ্ছে এটা জিওম্যাগনেটিক ফিল্ডের সমস্যা।
-তার মানে? চুম্বক ঠেলে ফেলে দিচ্ছে সবাইকে! মেয়ের পাণ্ডিত্যে চমকে উঠলেন মুকুন্দবাবু।
-ধুর, এ চুম্বক সে চুম্বক নাকি? আমাদের এই পৃথিবীটাও একখানা বিশাল চুম্বক, ভুলে গেলে? ঝামেলা হচ্ছে পৃথিবীর এই চৌম্বক ক্ষেত্রটা আমাদের লোহার চুম্বকের থেকে বেশ আলাদা। পৃথিবীর উত্তর মেরুটা সামান্য নড়া চড়া করে, তার কারণ হচ্ছে পৃথিবীর পেটের মধ্যে জমে থাকা গরম তরল লোহা। তাছাড়া, কয়েক লক্ষ বছরে একবার, এমনও হয় পৃথিবীর উত্তর আর দক্ষিণ মেরুটাই উল্টে যায়। যদিও খুব সামান্য সময়ের জন্যে। মুকুন্দবাবু অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন টুম্পির কথায় –
-‘আমাকে আর জ্বালাস না, টুম্পি। তোর কি মনে হচ্ছে, আমাদের বারান্দায় যে যখন পা তুলতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই পৃথিবীর মেরুদুটো ‘ও কুমীর তোর জলকে নেমেছি’ বলে কুমীরডাঙা খেলছে, আর ওপারে গিয়ে ভেসে উঠছে?
রুনুঝুনু খিক খিক করে হেসে উঠল বাবার কথায়, তার চেয়েও মজা পেল, বাবার কাছে দিদির হেনস্থাতে। দিদিটা এত পাকু, আর এত দিদিগিরি ফলায়, অসহ্য। টুম্পি দুই বোনকে একটুও পাত্তা না দিয়ে বাবাকে বলল –
-তোমার ফোনটা দাও তো, বাবা।
-কেন, এখন আবার কাকে ফোন করবি?
-সরুদাকে।
-সরু কি করবে?
-এমনি, ব্যাপারটা বলব, সরুদা কি বলে দেখি না।

সর্বজিৎ, ডাকনাম সরু টুম্পিদের মাসতুতো দাদা। খুব ভালো ছেলে, আই আই টি কানপুরে পড়ে, থার্ড ইয়ার। টুম্পির ধারণা বিজ্ঞানে সরুদা হচ্ছে শেষ কথা। মুকুন্দবাবু টুম্পির হাতে ফোনটা দিয়ে উঠে গেলেন ঘরের বাইরে বারান্দায়। রুনুঝুনু নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে চুপটি করে দেখতে লাগল দিদির কাণ্ডকারখানা। সরুদাকে ফোনে সব কথা বলল টুম্পি, তারপর নিজের ব্যাখাটাও শোনাল খুব জাহির করে। শুনে সরুদা এত জোরে হাসল হো হো করে, রুনু-ঝুনুও পরিষ্কার শুনতে পেল সেই আওয়াজ। টুম্পির মুখটা খুব করুণ দেখাচ্ছিল তখন। রেগে গিয়ে টুম্পি বলল-
-বেশি হ্যা হ্যা করে হেসো না তো? খুব যে হাসছো, তুমিই তাহলে বল না ব্যাপারটা কি?
-সিম্পল, ভূত। ভবিষ্যত হয়তো থাকবে, বর্তমান নিশ্চয়ই রয়েছে, ভূত তো তাহলে ছিলই। হাসি থামিয়ে সরুদা ফোনে বলল টুম্পিকে। টুম্পি বেজার মুখ করে ভেংচি করে উত্তর দিল –
-‘ভূত তো তাহলে ছিলই’, ছিলই যদি, তাহলে সেটা বর্তমান হয়ে গেল কি করে, শুনি?
-সে অনেক জটিল ব্যাপার, এখন তুই বুঝবি না। আরো ছোট হ’, বুঝতে পারবি।
-ছোট হবো, তার মানে?
-হুঁ ছোট হ’। ছোটরা অনেক কিছু চট করে বুঝে ফেলে, বড়োরা পাকামি করতে গিয়ে কেঁচিয়ে একশেষ হয়। চিন্তা করিস না, রুন্টু-ঝুন্টু ঠিক জানে, দেখে নিস। সরুদা রুনুঝুনুকে আদর করে রুন্টুঝুন্টু বলে। ফোনটা কেটে দিয়ে, টুম্পি বলল-
-বলে কি না, ভূত? এক নম্বরের ভূত।
রুনুঝুনুর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সরুদা কি বলল পুরোটা শুনতে, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না, মা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এমন তাগাদা দিলেন, ফোন রেখে টুম্পি ঢুকে পড়ল বাথরুমে। রুনু ঝুনুকে চুপিচুপি বলল-
-সরুদা, ভূতই বলল, না? কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঝুনু বলল –
-সরুদা, সবই তো জানে।



ছোট্ট নিরিবিলি শহর প্রফুল্লনগর তোলপাড়।

চারপাঁচদিনে মুকুন্দবাবুর কোয়ার্টারের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। লোকাল কেব্‌লে দিনে সতেরবার দেখাচ্ছে ওই বারোর এ-র ছবি। ওরা দুটো ডানপিটে ছোঁড়াকে ধরে বারান্দায় ওঠার এবং ধাক্কা খেয়ে চিৎপাত হবার লাইভ রেকর্ডিং করেছিল। সেটা স্লো মোশনে লাগাতার দেখাচ্ছে, সিনেমার ফাঁকে ফাঁকে। কোয়ার্টারের সামনের মাঠটায় মেলার মতো ভিড়। লাল আর বেগুনি রংয়ের কাপড়ের তাঁবু ফেলে আস্তানা গেড়েছে এক জটাধারি সাধু, সঙ্গে তার দুই চেলা। সাধুবাবার গা হাত পা টিপছে, আর মাঝে মাঝে ব্যোম শংকর হুংকার দিচ্ছে। সাধুবাবা বলছে – ওই বাড়িতে বাসা বেঁধেছে বেম্মদত্তি। ইয়াব্বড়ো গোঁফ, মাথায় বাবরি চুল আর কাঁধে ধবধবে পৈতে। দখল করে নিয়েছে বাড়িটা, কাউকে ঢুকতে দেবেনা। যদিও অনেক হ্যাপা কিন্তু এর একমাত্র সমাধান “মহাপ্রবেশ যজ্ঞ”।  দেবাদিদেব মহাদেবের সাক্ষাৎ চেলা এই সাধুবাবা, তাঁর আদেশ – যা বেটা, পার কর দে মুকুন্দ্‌কো অওর উস্‌কা পরিবারকো, বসা দে উন্‌কা ঘর। মহাদেবের আদেশেই হিমালয় থেকে সরাসরি সাধুবাবা এসেছে। আর দেবতার কি লীলা, সুদূর কৈলাসেও বিখ্যাত হয়ে গেছেন মুকুন্দবাবু!     

বিস্তর লোকজন আসছে, মুকুন্দবাবুর কোয়ার্টার দেখতে, আর সেই সঙ্গে সাধুবাবার কাছে ভাগ্য গণনা করতে। বাবামহাদেবের সঙ্গে যে সাধুবাবার রোজ কথা হয়, সেটা জানতে আর কারো বাকি নেই। সেইসঙ্গে চারদিকে বসে গেছে, অনেক ফেরিওয়ালা। এগরোল থেকে জিভে জল আনা আচারের স্টল। আইসক্রিম, বুড়িরচুল, ফুচকা, চুরমুর, আলুকাবলি সারাদিনে এত বিক্রি হচ্ছে, সামলাতে পারছে না ফেরিওয়ালারা।

মুকুন্দবাবুরা হরিদ্বার ঘুরে যেদিন আসানসোলে ট্রেন থেকে নামলেন, স্টেশনের বাইরেই শুনলেন, মিনিবাসের কণ্ডাকটার হাঁকছে মুকুনবাড়ি, মুকুনবাড়ি। বাসের গায়ে লেখা আছে প্রফুল্লনগর-আসানসোল, এটা যে তাঁদের ওদিকেই যাচ্ছে, সেটা না বোঝার কোন কারণ নেই, কিন্তু মুকুনবাড়ি স্টপেজটা কোথায় তিনি বুঝতে পারলেন না। প্রফুল্লনগর যাবার বাস চিরকাল তিনি আসানসোল বাসস্ট্যান্ড থেকেই ছাড়তে দেখেছেন। এবারে স্টেসন থেকে ছাড়তে দেখে তিনি অবাক হলেও লটবহর নিয়ে বাসে উঠে পড়লেন, সিটও পেয়ে গেলেন সকলে। আরো লক্ষ্য করলেন পাঁচমিনিটের মধ্যে বাস ছেড়ে দিল, কারণ বাসটা ভরে গিয়ে গেটে দুজন ঝুলছে! পিছনে আরো দুটো প্রফুল্লনগরের বাস দাঁড়িয়ে, কণ্ডাকটারগুলোও ডাকছে মুকুনবাড়ি, মুকুনবাড়ি। সে বাস দুটোও ভরতে দেরি নেই, এত লোকের ভিড়। 

বাড়ির যতো কাছাকাছি আসছেন, ততই দুশ্চিন্তা বাড়ছে মুকুন্দবাবুর, আর তাঁর স্ত্রী ঘন ঘন হাত জোড় করে মাথায় ঠেকাচ্ছেন হরিদ্বারের পুষ্প। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বললে মুকুন্দবাবুর দুশ্চিন্তার চাপটা একটু হয়তো কমত, কিন্তু ভিড়ের জন্যে বলতে পারছিলেন না। কিন্তু রূপনারায়ণগঞ্জ বাসস্টপে ঘোষবাবু বাসে উঠে মুকুন্দবাবুকে দেখতে পেয়ে দরজা থেকেই বললেন – কি মুকুন্দবাবু, বাড়িতে জলজ্যান্ত বেম্মদত্তি পুষছেন, আর আমরা কেউ জানতেই পারলাম না! মুকুন্দবাবু যে ভয়ে এতক্ষণ কথা বার্তা বলছিলেন না, সেটাই ঘটে গেল। বাসের সব লোক মুকুন্দবাবুর দিকে গোলগোল চোখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একজন দেহাতি ওই ভিড়ের মধ্যেই নীচু হবার চেষ্টা করতে করতে বলল – গোড় লাগি, মহারাজ, গোড় লাগি। বোলো মুকুনমহারাজ কি জয়। বাসভর্তি লোক এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল – জয়। লাগাতার জয়ধ্বনি শুনতে শুনতে মুকুনবাড়ির রহস্যটাও তাঁর বোধগম্য হল – মুকুন্দবাড়ি, দেহাতি ভাষায় মুকুনবাড়ি হয়ে গেছে।

আমলাবাগান মার্কেটের বাসস্টপটাই মুকুন্দবাবুর বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছে। একটু আগেই তিনি মেয়েদের তাড়া দিলেন, রেডি হ’ নামতে হবে সামনের স্টপে। সেই শুনে ঘোষবাবু, আর বাসের কণ্ডাক্টর হৈ হৈ করে উঠল। বাস তো আপনার বাড়ির সামনে দিয়েই যাবে, সবাই নামবে, ওখানেই খালি হয়ে যাবে। ভক্তি গদগদ সেই দেহাতি লোকটা নীচু হয়ে বলল – ‘পরেশান মত হোইয়ে মহারাজ, সব হি আপকা কিরপা’তারপর দুহাত তুলে বলল ‘মুকুনদেও কি জয়’, সমস্বরে রব উঠল ‘জয়’।

সত্যি সত্যি বাসটা রাস্তা পালটে তাঁর বারোর এ কোয়ার্টারের সামনে থেমে গেল। হুড়মুড় করে নামতে লাগল বাসের সব যাত্রী। সবার শেষে মুকুন্দবাবুরা ধীরে সুস্থে নেমে এলেন, তাঁদের লটবহর নামিয়ে দিল বাসের যাত্রীরাই! বাস থেকে নামা মাত্র চেনাজানা পড়শিরা ঘিরে ধরল তাঁদের। পাশের কোয়ার্টারের বক্সিদা আর বৌদি বললেন – ‘এবেলা আমাদের বাড়ি চলো, তেতেপুড়ে এসেছ, একটু জিরিয়ে নাও। ওবেলা দেখা যাবে যাগযজ্ঞ কি করলে কি করা যায়। মুকুন্দবাবু আর তাঁর স্ত্রী হকচকিয়ে দেখতে লাগলেন সবকিছু, মাঠের মেলা, মাইকের ভজন, চারপাশের গিজগিজে ভিড়।

টুম্পিও হতভম্ব হয়ে বাড়ির লোহার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছিল, তাদের বাড়িটা নিয়ে এমন কাণ্ড হচ্ছে! এদিকে রুনু আর ঝুনু লোহার গেট খুলে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তায়। দুইবোন হাত ধরাধরি করে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে দিদিকে ডাকল-
-এই মেজদি, বাড়ি ঢুকবি না। ডাক শুনে টুম্পি ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দেখেই চিৎকার করে উঠল –
-কি করছিস কি তোরা, পালিয়ে আয়। তার চিৎকার শুনে আশেপাশে সকলেই চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। সমস্বরে আর্তনাদ করে উঠল – ‘না’ততক্ষণে রুনুঝুনু উঠে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়, দুজনের মুখেই হাসি, টুম্পিকে বলল –
-‘বাবার থেকে চাবিটা চেয়ে আন না, মেজদি, দরজাটা খুলি’।


বাসায় ঢুকেই পনের দিনের পড়ে থাকা ঘরের ধুলো সাফ করতে লেগে গেলেন মুকুন্দবাবুর স্ত্রী। মুকুন্দবাবু চট করে বেরিয়ে এনে দিলেন আলু, ডিম আর টুকটাক জিনিষপত্র। টুম্পির ঘাড়ে পড়ল ভাত আর ডিমের ঝোল রান্নার দায়িত্ব। গোছগাছ সেরে, চান খাওয়া করতে করতে সাড়ে তিনটে বেজে গেল। দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তি আর চরম দুশ্চিন্তার অবসানে, সকলেই ঘুমিয়ে নিলেন ঘন্টা দুয়েক। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাইরে বারান্দায় এসে বসলেন মুকুন্দবাবু, তাঁর স্ত্রী আর টুম্পি। রুনুঝুনু চা বানাচ্ছে তিনজনের জন্যে। রাস্তা পার হয়ে সামনের বিরাট মাঠটা আগের মতোই শুনশান। গোটা পাঁচেক কুকুর কি সব শুঁকে শুঁকে বেড়াচ্ছে আর অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোচ্ছে, সাধুবাবার ফেলে যাওয়া ধুনি থেকে। এসব দেখে কে বলবে কয়েক ঘন্টা আগেও ওখানে বসেছিল জমজমাট মেলা। রুনুঝুনু বাবা-মা আর দিদিকে চা দিয়ে, বারান্দার ধারে দাঁড়াল। সামনের মাঠের দিকে তাকিয়ে রুনু বলল –
-ইস, অমন সুন্দর মেলাটা কি রকম ভেস্তে গেল, না? ঝুনু উত্তর দিল-
-সত্যি, এই সময় দিব্বি চুরমুর খাওয়া যেত, কতদিন চুরমুর খাওয়া হয় নি, বল?
-আর ফুচকা? ইস, একদম ঘরের সামনে, বাটি ভরে তেঁতুলজল নিয়ে নেওয়া যেত, কি মজা। ইস।
দুবোনে জিভে জল টানার শব্দ করে হাসল। মুকুন্দবাবু তিন চার চুমুক চা খেয়ে ওদের ডাকলেন –
-রুনু, ঝুনু, এইদিকে আয় দেখি, আমার কাছে বোস। দুজনে বাবার পাশে এসে বসল। মুকুন্দবাবু আবার বললেন –
-এবারে বল তো, ব্যাপারটা কি হয়েছিল? রুনুঝুনু ভয় পাওয়া মুখে বসে রইল মুখ নীচু করে।
-কোন ভয় নেই, বল না কি হয়েছিল। আমি জানি, তোরা সব জানিস। আমাদের সকলের দুশ্চিন্তায় ঘুম ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু আমি দেখেছি তোরা দুটিতে বেশ মজা পাচ্ছিলি আমাদের কথাবার্তায়। রুনু ঝুনুর মুখের দিকে একবার তাকালো, ঝুনু ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে রুনুর কাঁধে হাত রাখল। রুনু বলল –
-বেড়াতে যাবার দিন, তুমি বললে না, পনের দিন বাড়িটা শুধু দুটো তালার ভরসায় ছেড়ে যাওয়াটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে, তাই – রুনু একটু দ্বিধা নিয়ে থেমে গেল।
-তাই, কি? মুকুন্দবাবু অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন। টুম্পি এবং মুকুন্দবাবুর স্ত্রীও আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন দুই বোনের দিকে।
-তাই, আমরা রুকু আর সুকুকে বলে গিয়েছিলাম, পাহারা দিতে। আমরা পাঁচজন ছাড়া, বারান্দায় কাউকে যেন উঠতে না দেয়।
-রুকু-সুকু, তারা আবার কে?
-ভূত।
-ভুত! যমজ ভুত?
-হ্যাঁ। ওরাও যমজ, তবে ভাই।
-তাদের কে তোরা চিনলি কি করে? পেলি কোথায়?
-ক্লাস সিক্সের রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল বলে তুমি আর মা বকবে ভয়ে আমরা দুজনে ওই গাছতলায় বসেছিলাম। মাঠের দিকে হাত তুলে গাছটা দেখাল রুনু। মুকুন্দবাবুর স্ত্রী বললেন –
-সর্বনাশ, ওটা তো পাকুড় গাছ! মুকুন্দবাবু হাত তুলে স্ত্রীকে চুপ করতে বললেন। রুনু আবার বলতে শুরু করল,
-সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল, হঠাৎ কান্নার আওয়াজ শুনে আমরা চমকে উঠলাম। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাইনি প্রথমে। তারপর দেখলাম আমাদের থেকে হাত তিনেক দূরে এইটুকুনি একটু চিকিমিকি আলো, আর সেদিক থেকেই আসছে কান্নার আওয়াজ। আরো ভালো করে লক্ষ্য করে দেখতে পেলাম, ফ্যাকাসে রঙের সুকুকে। সুকু হাঁটু ধরে কাঁদছে, তার চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে ঝাপসা রুকু, আর খুব চেষ্টা করছে সুকুকে ভুলিয়ে রাখতে।
-তোদের ভয় করে নি? মুকুন্দবাবু জিগ্যেস করলেন।
-না, আমরা এমনিতেই তোমাদের ভয়ে ছিলাম, আর কতো ভয় পাবো? মুকুন্দবাবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-বোঝো কাণ্ড, তারপর?
-ঝুনুই প্রথম কথা বলল, জিগ্যেস করল তোমরা কারা? ও কাঁদছে কেন?
-আমার নাম রুকু, আর ও হচ্ছে সুকু, আমরা দুভাই, ঠিক তোমাদের মতো যমজ। আজকে ফুটবল খেলতে গিয়ে পল্টুর বলে ও এমন জড়িয়ে গেল, হাঁটুর ছাল উঠে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে, তাই কাঁদছে।
-ওখানটায় আলো জ্বলছে কেন?
-ওমা, তাও জানো না, তোমাদের যেমন ছাল উঠে গেলে রক্ত বেরোয়, আমাদের বেরিয়ে পড়ে, আলো। রাত্রে আলো আর দিনের বেলায় কালো। আমাদের চামড়ার রং আবার উল্টো, দিনের বেলা আলো আর রাতের বেলা কালো। সেই জন্যেই তো আমাদের চট করে দেখা যায় না। মুশকিল কি জানো, ওর ওই কাটা থেকে যতো আলো বেরোবে, ও ততো ফ্যাকাসে হয়ে যাবে, আর ওকে দেখতে পেয়ে যাবে মানুষেরা। তা হলেই আমাদের খুব বিপদ। সবাই তো তোমাদের মতো ভালো নয়।
সেদিন আমরা ওদের দুজনকে আমাদের বাড়ি এনেছিলাম, ওরা ওই পেয়েরা গাছের নীচে এসে দাঁড়িয়েছিল চুপটি করে। আমরা ডেটল দিয়ে সুকুর হাঁটুটা মুছে একটা ব্যান্ড-এড লাগিয়ে দিতেই, ওর আলো পড়া বন্ধ হয়ে গেল। তিন চারদিনের মধ্যে সেরেও উঠল সুকু। সেই থেকে আমাদের সঙ্গে খুব ভাব।
-আহারে, মরে যাই, ছেলে দুটোর মা নেই বুঝি? চোখের জল মুছে মুকুন্দবাবুর স্ত্রী বললেন।
-আঃ দাঁড়াও না। সেদিন আমি আর তোদের মা তোদের কে রেজাল্ট নিয়ে খুব বকেছিলাম মনে আছে, তোরা ভয় পাস নি?
-বাঃরে, ভয় পাবো কেন? ভূতকেই ভয় পেলাম না যখন, তখন তোমাদেরকে কিসের ভয়?
টুম্পি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল –
-সরুদা, কি করে জানলো, ওদের কথা?
-গতবার সরুদা যখন এসেছিল, আমাদের সঙ্গে ওদের কথা বলতে দেখে ফেলেছিল যে, জিগ্যেস করেছিল ঝাপসাদুটো কে রে?
-সরুদা তিনদিনের জন্যে এসে দেখে ফেলল আর আমি দেখতে পেলাম না এতদিনেও।
-ছোট হ, দিদি, তুইও দেখতে পাবি। গম্ভীর মুখে টুম্পি বলল-
-হুঁ, সরুদাও একই কথা বলেছিল সেদিন। বড়ো হতে হতেও, ছোট্ট হতে হবেতা না হলে...
-**-

কোন মন্তব্য নেই: