আসছে "দশে দশ" গল্প সংকলন
এই সংকলনের তৃতীয় গল্প "প্রতিবাদের আলো"-র কিছু অংশ
......রাত তখন কত কে জানে। ঘড়ি তো নাই। ক্রাসিনের স্টোভে ভাত চড়ায়েচেলাম, সঙ্গে
দুটা আলু পটল। দেওয়ালের ফাঁক ফোকরে আসা হাওয়ায় সে ইস্টোভের আগুনও সেদিন নির্জীবের মতো
ভিতু ভিতু। তবু ফুটতেচিল – চাল ফুটে ভাত হওয়ার সময় বাবু – হাঁড়িও খুব কথা কয়। লক্ষ্য
করেচেন কি বাবু। সে অনেক কথা। খিদের কথা। তৃপ্তির কথা। ভালোবাসার কথা। খিদের মুখে
দুটো অন্নর মতো ভালোবাসা জীবকে আর কে দেয়, কন তো বাবু? আমি বেশ বুঝতে পারি – ওদের
কথা। ওদের ঘ্রাণ। আমি খাটিয়ায় বসে, একমনে তাদের কথা শুনতেচিলাম আর দেখতেচেলাম ইস্টোভে
নীল আগুনের কাঁপা কাঁপা শিখা। মনের অন্দরে ছিলেন রাধামাদব আর তাঁর অনন্ত লীলা।
বাইরে তখন অশৈলী তাণ্ডব আর ঘরে চলতিচে অন্নের যোগাড়, এ কি রাধামাদবের লীলা নয়, কি
বলেন বাবু?
সেই সময়ে ঝাঁপ পড়া দরজায় আওয়াজ উঠল ঝমঝমিয়ে। প্রথমটায় বুজিনি বাবু ভেবেচেলাম
ঝড়ের বাতাসে অমন হচ্চে। বেশ অনেকক্ষণ পর কান করে যেন শুনতে পেলাম এক মেয়েমানুষের গলা – কেউ আচো, খোল
না – দোরটা খোলো না একটিবার। আর তার সঙ্গে ঝমঝম দরজা ঝাঁকানোর আওয়াজ। মনে হল ভুল
শোনলাম। এই দুর্যোগের রাত্রে কে আমার এই দোকানে আসতে যাবে। ভয় হল। অশরীরি কেউ নয়তো
– শুনেচি এমনি রাতেই তাঁদের আনাগোনা বাড়ে। আবার মনে হল তেনাদের কাছে আমার ওই পলকা
দোর কিসেরই বা বাধা? তেনাদের ইচ্চে হলে, অমনিই তো আসতে পারেন। রাধামাদব শক্তি
দিলেন, বিবেক দিলেন। দোরটা খুললাম। দামাল ঝোড়ো হাওয়া আর তুমুল বিষ্টির ঝাপটার
সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকে পড়ল একজন মেয়েমানুষ। এক ঝলক দেখার পর সব অন্ধকার – ঝোড়ো হাওয়ায়
আমার ঘরে জ্বলতে থাকা কুপিটা তখন নিভে গেচে।
ঝাঁপ বন্ধ করে, দেশলাই খুঁজে আবার কুপিটা জ্বালালাম আর তার আলোয় দেখলাম সেই
মেয়েরে। মাথা থেকে পা অব্দি ভিজে সপসপ করচে, পরনের কাপড় চুপ্পুরি ভেজা আর কাদামাখা।
মাটিতে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্চে সেই মেয়ে – তার পায়ের তলার মাটি ভেসে
যাচ্চে জলে আর রক্তে। মেয়েটি বাবু ভরা পোয়াতি। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে ইস্টোভে
জল চাপায়ে দিলাম। এই অসময়ে কার কাচে যাবো, এ অবস্থার মেয়েটারে নিয়েই বা এখন কি করব ভাবতেচেলাম,
আর অপেক্ষা করতেচেলাম জল গরমের, ততক্ষণে শুনতে পেলাম বাবু কচি শিশুর কান্না। সেকি
জোর বাবু তার গলার। বাইরের এত ঝড়ের গর্জন, বিষ্টির মাতন - সব ছাপিয়ে জেগে উঠল তার
কান্না। এ নতুন জেবনের কান্না, তাকে আটকায় এমন সাধ্যি কার। কোনদিন, বাবু, সংসার
ধর্ম করি নাই, রাধামাদবের নাম নিয়েই দিব্বি কাল কাটাইতেচেলাম, সেই আমার কাচেই কিনা
এসে জুটল এমন ঝক্কি? এমন খেলা রাধামাদব ছাড়া, আর কেই বা খেলতে পারেন বলেন দিকি।
পেথমেই বাচ্চাটার নাড়ি কেটে মুক্ত করে দেলাম তার মায়ের বাঁধন। তারপর গরমজলে
সাফসুতরো করে আমার পুরোনো ধুতির পুঁটলিতে জড়িয়ে ফেললাম তাকে। এতক্ষণ তার মাকে
লক্ষ্য করি নাই, এখন মায়ের কোলে বাচ্চারে তুলে দিতে গিয়ে দেখি মায়ের অবস্থা
সঙ্গীণ। বাচ্চারে কোলে নিতে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করে্চিল একবার – কিন্তু পারল না।
তার চোখের দৃষ্টি তখন থির, চোকের কোলে জমে উঠেচে জল, কিন্তু তার ফ্যাকাসে ঠোঁটের
কোণায় হাসির রেখা। বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার চোখ বুজে এল বাবু, আর সে
চোখ মেলল না।
আচ্ছা, রাধামাদবের এ কেমন লীলা আপনি আমারে বোজান দেকি। আমি কথা বলার
জন্যি মানুষ খুঁজতেচিলাম, তা না হয় সত্যি, তাই বলে এমন মানুষ। চেনা নাই, জানা নাই।
কোথায় বাড়ি, কাদের মেয়ে। না আমি জানি তার কিছু, না সে আমারে জানে। অথচ দেখেন, সে
চলে গেল আমার হাতে এই টুকুন এক জেবন গচ্ছিত রেখে? আমার চাল নাই চুলা নাই, রাধামাদবের
ইচ্চেয় আমার দিন চলে যায় কোনমতে, সেখানে একি বিপদ কন দিকি। আজ রাতটুকুন
হয়তো কোন পেকারে চলে যাবে – কিন্তু কাল সকালে? লোক আচে, জন আচে, থানা আচে, পুলিশ
আচে – তা্রা কি আমারে ছেড়ে দিবে? কি করব কিছুই যখন ভেবে কূল করতে পারতেচি না, আমার
কোলের পুঁটলিতে ওই মেয়ে কথা কয়ে উঠল। কি কথা কে জানে – শিশুর ভাষা বোঝার সাধ্যি তো
আমার নাই বাবু। আমি ওর মুখের দিকে চাইলাম – দেখি আমার দিকেই তাকিয়ে আচে টালুক টালুক
চোখে – সে দৃষ্টিতে কি যে ছেল বাবু, বলতে পারব নি। ভরসা ছেল। বিশ্বাস ছেল। সদ্যজাত
শিশু আরেকজন মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে কিসের সন্ধান করে? বাঁচার পেত্যয় ছাড়া? বড়ো
মায়া হল বাবু, অর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, অরে আরো জোরে চেপে ধরলাম বুকে।
অর ওই ছোট্ট বুকের ধুকধুকুনি আমার বুকে এসে বাজতে থাকল, বাবু। আমি রাধামাদবকে বললাম,
এ আমার কি করলে ঠাকুর, আমারে এ কি মায়ার বাঁধনে বেঁধে দিলে অচেনা অজানা কার এক
শিশুর সঙ্গে?...
২টি মন্তব্য:
কষ্ট হল খুব। কিন্তু বাস্তবের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার উপায় তো নেই...
এক সন্ধেয় এক-আধ ঘন্টা মোমবাতি জ্বেলে আমরা নাটক করতে পারি, তাতে অসহায় ওই মেয়ে বা তার পরিবারের কী আসে যায়?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন