ছোট্ট নীড়ে পক্ষীমাতার পক্ষপুটে বড়ো হতে থাকে পক্ষীশাবক। সে শাবক মাতার তত্ত্বাবধানে বড় হতে হতে তার ছোট্ট দুই ডানায় পেতে থাকে ওড়বার শক্তি। যেদিন তার ওড়বার সাধ্য হয়, সে খুঁজে পায় অনন্ত আকাশ। সে দিন থেকেই তার চোখে ধরা দেয় নীড়ের সংকীর্ণতা! নীড়ের উষ্ণ স্নেহ আর নিরাপত্তার চেয়েও বড়ো হয়ে ওঠে আকাশের বিস্তার আর তার নিজস্ব জগত। তারপর একদিন সে আর ফিরে আসে না তার বাসায়। শূণ্য নীড়ে অপেক্ষা করতে থাকা বিষণ্ণ পক্ষীমাতা একসময় মেনে নেয় সন্তানের দূরত্ব, দীর্ঘশ্বাস ফেলে উড়ে যায় জীবনের পরবর্তী লীলায়!
মাস দুয়েকের র্যাগিং পিরিয়ডের পর মাস দুয়েক হস্টেল জীবনের সঙ্গে ধাতস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। এই চারমাসে আমার মধ্যে অনেকখানি পরিবর্তন এসে গিয়েছিল সেটা আমি নিজেই উপলব্ধি করছিলাম। চারমাস আগে, যে আমি হস্টেলে এসেছিলাম, মানসিকতায় ও চালচলনে এই আমির সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক। আত্মবিশ্বাস ও বাস্তববোধ বেড়ে গিয়েছিল, কমে আসছিল সূক্ষ্ম অনুভূতিসমূহ। আশৈশব মা ও বাবার সাবলীল নিয়মের বন্ধনমুক্ত প্রায়-উচ্ছৃঙ্খল হস্টেল জীবনযাত্রার প্রভাব ফুটে উঠছিল আচারে ব্যবহারে।
হস্টেলে র্যাগিং পিরিয়ড যখন চলছিল, মাকে চিঠি লিখতাম নিয়মিত। সে চিঠিতে র্যাগিংয়ের কোন অত্যাচারের কথাই উল্লেখ থাকত না, কিন্তু আমার মানসিক অস্থিরতাটুকু বুঝে নিতে এতটুকু অসুবিধে হত না মায়ের – সেটা বুঝতে পারতাম মায়ের উত্তরসমূহে। র্যাগিং পিরিয়ড সমাপ্তিতে যত অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলাম হস্টেলের জীবনে্র সঙ্গে, আমার চিঠি লেখা অনিয়মিত হয়ে উঠতে লাগল। চিঠির ভাষা হয়ে উঠল সীমিত, সংক্ষিপ্ত আর অনান্তরিক - যেন নিয়মরক্ষা! বৃহত্তর জীবনপ্রবাহের অনুকূল বাতাসে বেয়ে চলা তরীর কি মনে পড়ে, পাড়ে বিছিয়ে রাখা শান্ত সবুজ মৃন্ময়ী আঁচলের কথা?
মায়ের পক্ষে সে পরিবর্তন উপলব্ধি না করার কোন কারণ ছিল না। অধীর আগ্রহে মা অপেক্ষা করছিলেন আমার ফেরার। দরজা খুলে যখন তিনি বললেন – ‘এসে গিয়েছিস, আয়’ তাঁর চোখের প্রথম দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে গিয়েছিল আমার যাবতীয় পরিবর্তন। তাঁর আদরের ঘুনু যে আর সেই ঘুনু নেই – হয়ে উঠতে চলেছে মিঃ পান্নাবরণ সেটুকু বুঝে উঠতে তাঁর দেরি হয় নি।
বাড়িতে আসার দিন আমার প্রিয় রান্নার আয়োজনেই মা ব্যস্ত রইলেন। হস্টেলের রান্নার কোন ছিরিছাঁদ নেই এ কথা মা আমার মুখেই শুনেছিলেন। কিন্তু পরের দিন বাবা অফিস বেরিয়ে যাবার পরেই যখন আমিও বললাম
-ভাত দাও, বেরোব। মা যেন চমকে উঠলেন, বললেন -
–কোথায় যাবি? তেমন কোনো কাজ ছিল না, ছিল না তেমন কোন নির্দিষ্ট প্রোগ্রামও। হয়তো কোন বন্ধুর বাড়ি যাবো, সেখান থেকে ঠিক করা যাবে কোথায় যাওয়া যায়। স্পষ্ট কোন জবাব দিতে পারলাম না। ম্লান মুখে মা আবারও বললেন -
-এই তো এলি, কদিন পরেই আবার চলেও যাবি, এর মধ্যে না বেরোলেই নয়?
মায়ের চোখে চোখ রাখলাম –অসহায় বিষণ্ণতা চোখে। একা ও নিঃসঙ্গ। জোর করে আমাকে আটকে রাখার জোরটুকুও অবশিষ্ট নেই আর। এতই বড় হয়ে গেছি আমি! এর আগে আর কোনোদিন এভাবে দেখিনি মাকে, আমি হাসলাম, বললাম –
-ঠিক আছে বেরোব না, হয়েছে?
-হ্যাঁ হয়েছে, উজ্জ্বল চোখে হেসে মা বললেন – দাঁড়া তোর জন্যে মাছের ডিমের বড়া আর চা করে আনি – তুই ভালোবাসিস। ছোট্ট মেয়ের মতো খুশি হয়ে মা চলে গেলেন রান্নাঘরে।
মা যখন ডিমের বড়া আর চা নিয়ে এলেন, আমি শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলাম, মা বললেন –
-নে ওঠ, গরম গরম খেয়ে নে, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না। আমি উঠে পড়লাম। মায়ের কপালে আর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। কিন্তু এতটুকু ক্লান্তি নেই, খুব খুশি। মা নিজের জন্যেও চা এনেছিলেন, বসে খেতে খেতে বললেন –
-মামাবাড়ির ভামিমাসীকে মনে আছে তো, তোর?
-হুঁ।
-গতমাসে মারা গিয়েছে।
-তাই নাকি? আমার নির্বিকার স্বরে আমি নিজেই অবাক হলাম। এই দু বছর আগেও মামাবাড়ি গিয়েছিলাম যখন – তার চোখের দৃষ্টিতে দেখেছিলাম অহেতুকী ভালোবাসা। ভাঙাচোরা কালো মুখে নির্মল হাসি নিয়ে জিগ্যেস করেছিল – পান্নাদাদা কখন এলে? ভালো আছো তো, বাবা? নদিদি ভালো আছে, বাবা ভালো আছে? হীরকদাদা ডাক্তার হয়ে গেল, নয়?
-হ্যাঁ। দাদা চিঠি দিয়েছে। বেচারা খুব কষ্ট পেল, জানিস? ভালো মানুষদের এমনই হয়। জীবনে শান্তি পায় না। শেষদিকে চোখে ভালো দেখতে পেত না। ছেলেরা, ছেলের বউরা কেউ দেখত না। বুড়ি একা একা সব কাজ করত। পুকুরঘাটে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পেয়েছিল খুব। বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারত না। কে দেখবে? কে পথ্যি করবে? এক গ্লাস জল গড়িয়ে দেবারও কেউ ছিল না মরবার সময়। বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে বেড সোর – কি কষ্ট মানুষের। মরে গিয়ে শান্তিই পেল। সারাটা জীবন পরের বাড়িতে খেটে মরল বেচারা দুটো অন্নের জন্যে। আমাদের ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি কি খাটতে পারত, ভামি মাসী। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কামাইয়ের বালাই ছিল না। কোনদিন অসুখে পড়তে দেখিনি। সবসময় হাসিমুখ। খুব মায়া মমতা ছিল শরীরে। একবার বেশ মজা হয়েছিল, জানিস। সেবার পোষের সংক্রান্তি কাটিয়ে মায়ের কাছে গেছি, দিন পনের থাকবো বলে। আমার তখন বছর চারেক বিয়ে হয়েছে, তুই তখনো হস নি - হীরুর তখন বছর আড়াই বয়েস। গাঁয়ে যাত্রা হচ্ছে – কি বেশ নাম ছিল ভুলে গেছি। খুব যুদ্ধ-টুদ্ধ ছিল আর কি, বুঝলি? মাঝে মাঝেই ভীষণ ঢাল-তলোয়ারের লড়াই হচ্ছে, খুব জমাটি পালা। দাদা হয়েছিল কর্ণ – হ্যাঁ, মনে পড়েছে, যাত্রার নাম ছিল ‘কুন্তীপুত্র কর্ণ’। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। রণক্ষেত্রে কর্ণের রথের চাকা বসে গেল, লড়াই থামিয়ে কর্ণ গিয়েছে রথের চাকা মাটি থেকে টেনে তুলতে আর সেই সুযোগে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন ছুড়ে দিলে পাশুপত অস্ত্র। ব্যস, কর্ণ মারা গেল। ঘর থেকে আলতা নিয়ে গিয়েছিল, দাদা মারা যাবার সময় সেটা কায়দা করে ঢেলে দিয়েছিল নিজের জামায় আর মেঝেয়...। ব্যস ভামিমাসী ফিট হয়ে গেল সেই দৃশ্যে...এত অক্ত কেন গো, এত অক্ত কেন? অক্ত জানিস তো, রক্ত – ভামিমাসীরা রক্ত বলতে পারত না, বলতো অক্ত, রঙকে বলতো অঙ। ভামিমাসীর স্বামী তখনো বেঁচে ছিল – সে যত বলে ওটা অক্ত নয় গো, অক্ত নয় – ওটা অঙ। ভামিমাসী বুঝলে তো? এত সরলতা আর মায়া ছিল না, মানুষটার মধ্যে। সে মানুষটা এত কষ্ট পেল মারা যাবার সময় শুনে খুব মন খারাপ করছিল...
মা চুপ করে গেলেন। আমি মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছিলাম মায়ের কথা। ছোটবেলায় মায়ের কাছে অনেক গল্প শুনেছি। ভূতের গল্প, রূপকথার গল্প, রামায়ণ, মহাভারত আর পুরাণের গল্প - কিন্তু সে সব গল্প ছিল নিছক গল্পই। আজ মা যা শোনালেন সে তাঁর ফেলে আসা জীবনের কথা। তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিল মায়া, প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে ছিল মমতা।
আমার মামাবাড়ির প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ভামিমাসী ওতপ্রোত জুড়ে ছিল। তার বাইরে যে তার নিজস্ব একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে, এমন কোনদিন আমার মনেও হয় নি। আজকাল ‘ওয়ার্কহোলিক’ বলে একটা কথা খুব শুনি, সফল ব্যক্তিত্বের বর্ণনায়। ভামিমাসী কোন ব্যক্তিত্ব নয়, তার সারাদিনের কাজের কোন কৌলিন্যও ছিল না। মায়ের কাছে ভামিমাসীর জীবনের এই একটামাত্র ঘটনা শুনে আমার চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল। আমার ভাবনা চিন্তার নিদারুণ কূপমাণ্ডুক্য প্রকট হয়ে উঠল আমার নিজের চোখেই!
আমরা যখন কাছে ছিলাম, মায়ের সমস্ত চিন্তা জুড়ে থাকত আমাদের সুবিধে-অসুবিধে, কল্যাণ – অকল্যাণ। আমদের বড়ো করে তোলা, মানুষ করে তোলার চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল তাঁর সমস্ত মনন। রেডিওতে বাংলা গান শোনা ছাড়া তাঁর আর কোন বিলাসিতা কোনদিন দেখিনি। কলকাতা শহরে এতদিন থেকেও কটা সিনেমা তিনি দেখেছেন, হাতে গুনে বলে ফেলা যায় অনায়াসে। তাও দেখেছেন হয় সত্যজিতের সিনেমা অথবা কোন মহাপুরুষের জীবনী – যা আমাদের সঙ্গে নিয়ে দেখা চলতে পারে। এও এক তপস্যা বলেই আমার মনে হল।
মায়ের সেই তপস্যা সিদ্ধ হয়েছে – দুই সন্তানের একজন ডাক্তার, অন্যজন হতে চলেছে ইঞ্জিনীয়ার। দুই শিশুর গর্বিতা জননী হিসেবে যে স্বপ্ন তিনি লালন করে এসেছেন এতদিন – তা আজ পূর্ণ। স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে অনলস শ্রমের পর আজ তাঁর লক্ষ্যহীন অখণ্ড অবসর। তিনি নিঃসঙ্গও হয়ে পড়েছেন নিদারুণ।
উপলব্ধি করলাম এই কটা মাসে আমিও যেমন অনেকটা বড়ো হয়ে গেছি, মায়েরও বয়েস হঠাৎ অনেকটাই বেড়ে গেছে! দুই ভাইয়ের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে মায়ের কত কাজ যে কমে গেছে! জামাকাপড়ের আলনা এলোমেলো হয় না। দিনের পর দিন পড়ার টেবিল, বইয়ের শেল্ফ্ ঠিকঠাক সাজানো থাকে। বালিশের তলা থেকে ভিজে গামছার পুঁটলি বের হয় না। মিটশেফ থেকে চুরি হয় না কোন লোভনীয় খাবার! এককথায় তাঁর জীবন থেকে মুছে গেছে দৌরাত্ম্য। কারণ তাঁর দুই সন্তানই বড় হয়ে গেছে অনেক।
সারাদিন দৌরাত্ম্যহীন একলা ঘরে কাজ খুঁজতে খুঁজতে তাঁর মনে আসে ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি। তাই ভামিমাসীর অবহেলিত মৃত্যুও তাঁর মনে নাড়া দিয়ে যায় ভীষণভাবে। ভামিমাসীর কথা শেষ করে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেলেন খালি চায়ের কাপ আর প্লেট নিয়ে।
খবরের কাগজের পাতায় চোখে পড়ল – অরুণাতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ চলছে। মাকে ডেকে বললাম-
-মা, সিনেমা যাবে? ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ – দারুণ হাসির সিনেমা। তুলসী চক্রবর্তী আর ভানু ব্যানার্জি আছে...চলো দেখে আসি।
-আমি? পাগল হয়েছিস নাকি? হঠাৎ আমাকে নিয়ে পড়লি কেন? আমার এখন কত কাজ। তুই বরং দেখে আয়।
-পাগল হবার কি আছে? ম্যাটিনি শো তিনটে থেকে শুরু। সাড়ে পাঁচটায় শো ভেঙে যাবে। ভাত খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আড়াইটে নাগাদ বেরোলেই যথেষ্ট। সারা জীবন তো অনেক কাজ করলে, আজ একটু ফাঁকি মারলে কেউ কিছু বলবে না, চলো।
-বাবাঃ, তুই দিব্যি কথা শিখেছিস তো? টিকিট পাবি? মুখে হাসি নিয়ে মা বললেন।
-আমি এখনই বের হচ্ছি, টিকিট ঠিক যোগাড় হয়ে যাবে। তুমি বরং এদিকে রেডি হও, আমি যাব আর আসবো।
সেদিন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখে মা খুশি হয়েছিলেন খুব, বাবা ও দাদা রাত্রে বাড়ি ফিরতে অনেকক্ষণ সিনেমা নিয়ে কথা বললেন। সেবার ছুটিতে দিন সাতেক বাড়িতে ছিলাম, চেষ্টা করেছিলাম যতটা সময় সম্ভব বাড়িতেই থাকতে। রোববার দিন মাকে সম্পূর্ণ ছুটিই দিয়ে দিলাম রান্নাঘরের কাজ থেকে। বেশ কিছুদিন আগে মা একবার শয্যাশায়ী অসুস্থ হয়েছিলেন, সে সময় মায়ের গাইডেন্সে আমার রান্নায় ‘হাতে খুন্তি’ হয়েছিল। সেদিন আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া গেল আমার রান্নার বিদ্যে। মা রান্নাঘরের বাইরে বসে যোগাড় করে দিচ্ছিলেন আর অনর্গল কথা বলছিলেন। সনাতন বাংলার নিরামিষ রান্নার রেসিপি আর মায়ের হাতের রান্না খেয়ে কে কি বলেছিলেন তার অতীত স্মৃতি। বহুদিন পর মাকে সেদিন এত খুশি আর হাল্কা মেজাজে দেখে ভীষণ মায়া হল মায়ের ওপর।
মায়ের এই ছোট্ট নীড়ের বাইরে আমাকে তো যেতেই হবে। আমার পায়ের শিকল ছিঁড়ে গেছে কবেই। এখন ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে আমার এই ফিরে আসায় মা যে আনন্দটুকু পেলেন, সেটাই হয়ে রইল আমার সারা জীবনের সম্পদ।
-০০-
এমনই সাঁইত্রিশটি অধ্যায় নিয়ে "বিনি সুতোর মালা"। যারা পড়েননি, কিন্তু পড়তে চান, যোগাযোগ করতে পারেন, আমার সঙ্গে অথবা সৃষ্টিসুখ প্রকাশনের সঙ্গে। ক্লিক করুন ওপরের লিংকেঃ-